সানোয়ার হোসেন, মির্জাপুর (টাঙ্গাইল)

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর

অর্ধশতাধিক স্থানে পাহাড় জমি, তীরের মাটি উজাড়

দলীয় নেতাদের টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজের দাবি মাটি ব্যবসায়ীদের * মাটি তোলা ও ব্যবসায় জড়িতরা ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী * জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা পেলে এসব বন্ধ সহজ হবে বলেছেন ইউএনও

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে অর্ধশতাধিক জায়গা থেকে পাহাড়ি লাল মাটি, ফসলি জমি ও নদীতীর কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। লাল মাটি কাটার ফলে নষ্ট হচ্ছে পাহাড়ি অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য। একই সঙ্গে ফসলি জমির মাটি কাটায় কমে যাচ্ছে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। এ ছাড়া নদীর গতিপথ অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হয়ে অনেক ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু ও স্থাপনা হুমকিতে পড়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের পাথালিয়াপাড়ায় তিনটি স্পটে দেওহাটা এলাকার ফরিদ খান, ইলিয়াস মল্লিক, সরোয়ার মল্লিক দিনে-রাতে মাটি তুলছেন। এ ছাড়া লৌহজং নদীর মীর দেওহাটা-বুধিরপাড়া অংশে নদীতে বাঁধ দিয়ে মাটি কেটে নিজেদের ইটভাটায় নিচ্ছেন মীর দেওহাটা গ্রামের আকবর। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এমন তথ্য দিয়েছেন।

জানতে চাইলে ফরিদ খান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা জমির মালিকের কাছ থেকে মাটি কিনে বিক্রি করি। নেতাদের টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চালাই।’

চান্দুলিয়া গ্রামের সাদেক আলী অভিযোগ করে বলেন, ‘চান্দুলিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশেই আমার সরিষাখেত নষ্ট করে রাস্তা বানিয়ে রাতে মাটি কেটে নিয়ে গেছেন বহুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রুমান খানসহ দেওহাটা এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী।’ এ ছাড়া চান্দুলিয়া নদীতে ‘বাংলা ড্রেজার’ (স্থানীয়ভাবে তৈরি) বসিয়ে যুবলীগ নেতা ছানোয়ার হোসেন মাটি তুলে বাড়ি ও পুকুর ভরাট করছেন বলেও জানা গেছে।

পৌরসদরের বংশাই এলাকায় অবস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা একাব্বর হোসেন সেতুর পশ্চিম পাশে নদীতীরের মাটি কাটছেন গোড়াইল গ্রামের আলমগীর মৃধা, কাউসার মৃধা ও টিটু মিয়া। জানতে চাইলে আলমগীর মৃধা এ বিষয়ে বলেন, ‘রেকর্ড করা জমি ক্রয় করে মাটি কাটছি।’ প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন তো অনুমতি দেয় না, তবু মাটি কাটি।’

লতিফপুর-চাঁনপুর সেতুর পাশে তালেব, কাজল, লিটন, দেওয়ান রাজীব, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাহিনুরসহ কয়েকজন ৫-৬টি এক্সকাভেটর (ভেকু) দিয়ে রাতে নদীতীরের মাটি তুলে নানা স্থানে বিক্রি করছেন। এতে করে হুমকিতে লতিফপুর-চাঁনপুর সেতুটি। জানতে চাইলে মাটি ব্যবসায়ী কাজল এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের পারমিশন নিয়েই ছয়-সাতজন মিলে ভেকু দিয়ে মাটি তুলছি।’

কুমারজানি ও হাতেম টাউন এলাকায় লাল মিয়া নামের ব্যক্তি নদীতীরের মাটি কেটে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এ ছাড়া ভূলুয়াতে বেলতৈল গ্রামের আলহাজ ও করিম মিয়া নদীতীরের মাটি তোলা অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সরেজমিনে গিয়ে।

ফতেপুর ইউনিয়নের এক টাকার বাজার এলাকায় উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শুভ আহমেদের নেতৃত্বে পাকুল্যার একাধিক ব্যক্তি মাটি তুলছেন। এসব মাটি বড় ড্রামট্রাক দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভরাট ও ইটভাটায় বিক্রি করছেন। তবে উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শুভ আহমেদ দাবি করেন, মাটি কাটার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তবে মাটি উত্তোলন করছেন পাকুল্যার পারভেজ বলেও জানান তিনি।

ফতেপুর ইউনিয়নের বৈলানপুর এলাকায় সোহেল মৃধা নদীতীরের মাটি তুলছেন। জানতে চাইলে সোহেল মৃধা বলেন, ‘আমরা জমি কিনে ২০ থেকে ২৫ জন মিলে ব্যবসা করছি।’ প্রশাসনের অনুমতির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ফোনে এসব কথা বলা ঠিক হবে না।’

আজগানা ইউনিয়নের কুড়িপাড়া মধুর টেকি স্থানে ওই এলাকার সুরুজ ও বাপ্পী, আজগানা পূর্বপাড়ায় আবুল মেম্বার ও শাজাহান ভেক্যুমেশিন দিয়ে মাটি তুলে অন্যত্র বিক্রি করছেন। তেলিনায় আশরাফ মেম্বার, কুড়িপাড়ায় মজিবর মেম্বার লাল মাটি তুলে বিভিন্ন ভাটায় দিচ্ছেন বলেও জানা যায়। মাটি ব্যবসায়ী আজগানা ইউপির সাবেক মেম্বার আশরাফ বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে লাল মাটি কাটতেছি। এক যুবলীগ নেতাকে টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করে চালাচ্ছি।’

তরফপুর ইউনিয়নের ছিটমামুদপুর গ্রামের করিম সিকদারের পাহাড়ি টিলার লাল মাটি ক্রয় করেছেন ওই এলাকার রুবেল ও আক্তার, তারা লাল মাটি চড়া দামে বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন করিম সিকদারের পুত্রবধূ।

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাহাড়পুর সেতুর পাশে নদীর তীর ও বাড়ি ঘেঁষে মাটি কেটে নিচ্ছেন ছানোয়ার হোসেন। ওই বাড়ির মালিক লাভলু মিয়া বলেন, ‘বাইমহাটি এলাকার ছানোয়ার আমার বাড়ির সীমানা ঘেঁষে মাটি কাটতাছেন। এইভাবে মাটি কাটলে আমার বাড়ি যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। এর আগেও তিনি এখানে মাটি কেটেছেন।’

এ ছাড়া উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের বাঁশতৈল, নয়াপাড়া, গায়রাবেতিল; আজগানা ইউনিয়নের বেলতৈল, হাঁটুভাঙ্গা, মজিদপুর; লতিফপুর ইউনিয়নের যোগীরকোফা, তরফপুর ইউনিয়নে গাজেশ্বরী, ধানচালা, নয়েজ মার্কেট; ফতেপুর ইউনিয়নের থলপাড়া ও পারদিঘী, জামুর্কী ইউনিয়নের গুনটিয়া, মাঝালিয়া, বানাইলসহ উপজেলার অর্ধশতাধিক স্পটে প্রভাবশালীরা রাতে বালু ও মাটি তুলে বিক্রি করছেন। তবে এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে অনিরাপদবোধ করেন অধিকাংশ ভুক্তভোগী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

পাথালিয়াপাড়ার এক গৃহিণী বলেন, ‘দিন-রাত এখান দিয়া ট্রাক চলে। আগে আমরা প্রতিবাদ করছি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। পুলিশ আহে, তাও কিচ্ছু হয় না। তাই এখন আর প্রতিবাদ করি না।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার পাল জানান, ‘অবৈধভাবে কৃষিজমি ধ্বংস হতে থাকলে এ এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করবেন বলেও জানান তিনি।

জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা বিনতে মতিন এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে মাটি ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা করছি এবং আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে কাজটি সহজ হয়ে যাবে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close