গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮

নৌকা না ধানের শীষ

ভোট উৎসবে সাজ সাজ রব

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট আজ। নির্বাচনকে ঘিরে তাই দেশজুড়ে বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভবনসহ আশপাশ এলাকাজুড়ে। এ ভোট উপলক্ষে নির্বাচন ভবনের আশপাশসহ সারা দেশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি আগেই শেষ করেছে সাংবিধানিক সংস্থা ইসি। একই সঙ্গে নিয়ে রেখেছে ফল প্রকাশের সব প্রস্তুতি।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটের প্রতীক নৌকা। তবে এই জোটের জাতীয় পার্টি ২৯ আসনে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে লড়াই করছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতীক হলো ধানের শীষ। বিএনপির অনুগ্রহে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বর্হিভূত দল জামায়াতে ইসলামি ২২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। প্রতীক বিবেচনায় এবার নৌকা বা ধানের শীষ—যারা জয়লাভ করবে, তারাই এবার সরকার গঠন করবে।

নির্বাচন কমিশনসহ সারা দেশের মানুষ প্রত্যাশা করছে, নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হবে। ভোট বিপ্লব ঘটবে দেশজুড়ে। জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে রায় প্রদান করবেন নির্বিঘেœ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটদান নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে কমিশন। বাড়তি নজরদারি থাকছে দেশের সব ভোট কেন্দ্রে। তিন স্তরের নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৭ লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্র পাহারায় থাকবে ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। এসব কেন্দ্রে পাহারায় থাকবে পুলিশ, আনসার ও গ্রাম পুলিশ, যা এবার প্রথমবার যোগ করা হয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।

ভোটগ্রহণ উপলক্ষে আজ সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে আগেই। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলবে টানা ভোটগ্রহণ। বিকাল ৪টার পর থেকে কেন্দ্র থেকে আসনওয়ারি ফল একত্রিত করে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে ফল ঘোষণা করা হবে। আর নির্বাচন ভবন থেকে বিটিভির সহায়তায় বেসরকারিভাবে সরাসরি ফল প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে, গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন, এরপর থেকেই অপেক্ষায় ছিল গোটাজাতি আরেকটি নির্বাচন দেখার জন্য। ওই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। কিন্তু এবার সব রাজনৈতিক দল ও জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ওই নির্বাচন থেকে এবারের নির্বাচনের পরিবেশ-আমেজ ভিন্নতর। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং মরা-বাঁচার লড়াই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য। তবে নির্বাচন যাই হোক, অন্য দল ও প্রতীক ছাপিয়ে মূল লড়াই এসে দাঁড়িয়েছে নৌকা-ধানের শীষের মধ্যে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে না কি পরিবর্তন হবে। তবে জয়-পরাজয় যাই হোক, সরকারে থাকবে হয় আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপি।

এদিকে, এ নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে পরস্পরবিরোধী অভিযোগ অব্যাহত আছে। নির্বাচনে কেউ কাউকে ছাড় না দিতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দিয়েছে নৌকা-ধানের শীষের প্রার্থীরা। বিএনপির অভিযোগ, সরকারি দল পুলিশ দিয়ে তাদের পোলিং এজেন্টদের হয়রানি করছে। কেন্দ্রে যেতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে নৌকার ভিন্ন মতাদর্শের নাগরিক ও ভোটারদের। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত হয়েই আবোল-তাবোল প্রলাপ বকছে বিএনপি। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এবং নৌকায় সরকার গঠন করবে এটা সুনিশ্চিত বলে মনে করছে দুই মেয়াদে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ।

এমনকি বিভিন্ন জরিপে দলটির পুনরায় ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা বেশি বলে জরিপের ফলে দেখানো হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলেছেন, এবারের নির্বাচনের যে পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে ২০০-এর বেশি আসন পাবে নৌকা।

এদিকে, এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন আকর্ষণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ। জাতীয় নির্বাচনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ প্রযুক্তির প্রবর্তন করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন কে এম নুরুল হুদার কমিশন। এর আগে ড. শামসুল হুদার কমিশন ইভিএম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যবহার করে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ৬টি আসনের সব কেন্দ্রে এ প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ব্যালটে ভোটের প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগেই ওই ৬টি আসনের ফল জেনে যাবেন দেশবাসী।

তবে এবার দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও কূটনীতিক সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ এ নির্বাচনে ভোট পর্যবেক্ষণ করবে। এর মধ্যে বিদেশি ১০ সংস্থার পর্যবেক্ষক ৩৮ জন, বিদেশি কূটনীতিক ৬৬ জন, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক ৬১ জন এবং ১০০ জন বিদেশি সাংবাদিক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাত্র দুজন বিদেশি পর্যবেক্ষক এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিল।

এবার একাদশ জাতীয় নির্বাচনে নতুন প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটার প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন। এসব ভোটার জয়-পরাজয়ে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। দশ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মুখোমুখি হয়েছে। এ নির্বাচনে নিবন্ধিত সবকয়টি (৩৯টি) রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এ নির্বাচনে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮৬১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী প্রায় ১ হাজার ৭৩৩ জন। বাকিরা অর্থাৎ ১২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী অংশ নেওয়ায় এবার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল বর্জন করেছিল। এবারের নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়ায় সারা দেশে নির্বাচনী আবহ বিরাজ করছে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার ৩০০ আসনে মোট ভোটার রয়েছেন ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার। এতে ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্র ও ২ লাখ ৬ হাজার ৪৭৭ জন ভোটকক্ষ রয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও বাধাদানের পাঁচ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে নির্বাচন কমিশনে। এর মধ্যে বেশিরভাগই বিএনপির ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের। এছাড়া আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোট, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দলও একই অভিযোগ করেছেন। বড় দুই দল এ নির্বাচন ভণ্ডুল করার মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছে একে অপরের বিরুদ্ধে।

নির্বাচনে মাঠে সেনা, বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনী : নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারা দেশে সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে দেশের ৩৮৯টি উপজেলায় সেনা ও ১৮ জেলায় নৌ বাহিনীর সদস্য মাঠে নেমেছেন। তারা ভোটের পর ২ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে বিজিবি ও কোস্টগার্ড মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। সারা দেশে র‌্যাব ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যরাও মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে নেমেছেন। তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের তত্ত্বাবধানে কাজ করছেন।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, এবারের নির্বাচনে মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরের সাধারণ কেন্দ্রগুলোতে ১৪ থেকে ১৫ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ওই সংখ্যা থেকে একজন করে বেশি রাখা হবে। পার্বত্য এলাকা, দ্বীপাঞ্চল, হাওর এলাকার কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা আরো বেশি থাকবে। ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভোটগ্রহণের দুই দিন আগে মোতায়েন করা হবে।

শুধু ভোটকেন্দ্র পাহারায় পুলিশসহ ৬ লাখ ৮ হাজার জন সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যে পুলিশ ১ লাখ ২১ হাজার, আনসার ৪ লাখ ৪৬ হাজার ও গ্রাম পুলিশ ৪১ হাজার। এছাড়া ৪১৪ প্লাটুন সেনা, ৪৮ প্লাটুন নৌ বাহিনী, কোস্টগার্ড ৪২ প্লাটুন, বিজিবি ৯৮৩ প্লাটুন ও র‌্যাব ৬০০ প্লাটুন। এছাড়া স্টাইকিং ও রিজার্ভ র্ফোস হিসেবে ২ হাজার প্লাটুন র‌্যাব ও বিজিবিসহ ৬৬ হাজার নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করছে।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, এবার নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালনে মাঠ পর্যায়ে ১ হাজার ২০০ জন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তবে সেনা বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং টিমের সঙ্গে একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট দেয়ার জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৯৩৭ জনের চাহিদা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল ইসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬৭৬ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

দেশের সব সংসদীয় আসনের নির্বাচন শেষ করতে ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ জেলায় সমসংখ্যাক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুই বিভাগীয় কমিশনার এ দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে ৫৮২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছে এ নির্বাচনে।

এবার নির্বাচনে ৩০০ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ৪০১৮৩টি; যার মধ্যে স্থায়ী কেন্দ্র ৪০ হাজার ১৫৬টি ও অস্থায়ী ২৭টি। আর ২০৭৩১২টি ভোট কক্ষের মধ্যে স্থায়ী কক্ষ ১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬০টি ও অস্থায়ী কক্ষ ১১ হাজার ৩৫২টি।

এবার কোটির ওপরে নতুন ভোটারসহ মোট ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। তবে মহিলাদের চেয়ে পুরুষ ভোটার বেশি; যার মধ্যে ভোটের ব্যবধান প্রায় ৯ লাখ। এবার পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন এবং মহিলা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২জন।

৬৬২১১৯ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা : এবার জাতীয় নির্বাচনে শুধুমাত্র ভোটারদের ভোটদানে সহায়তা করার জন্য ৬ লাখ ৬২ হাজার ১১৯জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যে প্রিসাইডিং অফিসার ৪০১৮৩ জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন এবং পোলিং অফিসার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ধানের শীষ,নৌকা,ভোট,সংসদ নির্বাচন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close