মো. রাশেদ আহমেদ

  ২৪ আগস্ট, ২০২২

রাশিয়া-ইউক্রেন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ 

ফাইল ছবি।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে কিছু দিন পূর্বে World Economic Forum সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে অভিজ্ঞ মার্কিন কূটনীতিবিদ হেনরি কিসিনজার রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিরসনে সমাধানের পথ বাস্তবতার নিরিখে বাতলে দেন। তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দিয়ে মস্কোর সাথে সমঝোতা করা উচিৎ। অন্যথায়, এই সংঘাত গোটা ইউরোপকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এমন পরামর্শ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট মি.জেলেনেস্কি গ্রহণ করেননি।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান প্রায় ছয় মাস হতে চলছে। যেখানে সংঘাত বন্ধের পথ দিনদিন সংকুচিত হয়ে দীর্ঘায়ত হচ্ছে যুদ্ধের গতিপথ। যা নিঃসন্দেহে বিশ্বের জন্য অশনি সংকেত। ইতিমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই যুদ্ধের শেষ কোথায়! অথবা সংঘাত জিইয়ে রেখেই বা পশ্চিমাদের লাভ কী! বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলো তাদের আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে কূটনীতিক তৎপরতার চেয়ে যুদ্ধকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। মস্কো-কিয়েভ সংঘাত যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, পরাশক্তি দেশুলোর জন্য একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া যতটা সহজ, তার চেয়ে বহুগুণে কঠিন সেই যুদ্ধের অবসান ঘটনো। অর্থাৎ একটা যুদ্ধের রেশ চলতে থাকে দীর্ঘকাল। যেমন ইরাকে যুদ্ধের অবসান ঘটলেও সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলমান। আবার আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের নিকৃষ্ট বিদায় ঘটলেও বর্তমান কাবুলে চরম অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান। মোদ্দা কথা, যুদ্ধ পরবর্তী আক্রান্ত দেশগুলো সহসাই মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সুতরাং হলফ করে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সমাপ্তি রেখা টানা কঠিন। কিংবা এই যুদ্ধের রেশ চলতে থাকবে দীর্ঘকাল। যা কিয়েভের জন্য অদূর ভবিষ্যৎতে ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টসাধ্য হবে।

বলতে দ্বিধা নেই, মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘতর হওয়ার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা অনেকাংশ দায়ী। যা ১৯৭৯ সালে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আগফানিস্তানে যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের পরোক্ষ সহযোগিতা প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ। যেখানে আফগানিস্তানের জাতিগোষ্ঠীকে পরোক্ষ সামরিক সহযোগিতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব। কার্যত, রাশিয়া-ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভে ১৮ দফা সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এতো বেশি বিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা অন্য কোন দেশে পাঠায় নি ওয়াশিংটন। যেখানে অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে যুদ্ধকে দীর্ঘায়ত করে রাশিয়াকে পরাজিত করা।

মূলত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব দুটি স্ট্র্যাটিজি অনুসরণ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, ইউক্রেনকে সার্বিক সামরিক সহযোগিতা প্রদান ও রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। দ্বিতীয়ত, অবরোধের মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করা। অতিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউক্রেনে পশ্চিমা বিশ্বের নীতি অনেকাংশ অকার্যকর। যা শুধু মাত্র, যুদ্ধ ক্ষেত্রকে রক্তাক্ত করছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল ইউক্রেনে পক্ষে আশার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রায় ৩০ শতাংশ ভূ-খণ্ড দখল করে নিয়েছে। এমনকি দোনেস্ক এবং লোহানেস্ক অঞ্চল প্রায় স্বাধীন। উল্লেখ্য, উক্ত দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মস্কো, উত্তর কোরিয়া। যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে উক্ত অঞ্চল দু'টি স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না- তা একপ্রকার নিশ্চিত। এদিকে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের ব্যাপ্তি যত বেশি গড়াবে, মস্কোর কাছে কিয়েভ ততই বেশি ভূখণ্ড হারাবে। সেইসাথে বাড়বে হতাহতের সংখ্যা। সঠিক তথ্য প্রকাশ না হলেও ইতিমধ্যে এই সংঘাতে চার হাজারের অধিক বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য দেশে আশ্রায় নিতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়ার দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছে। যা ভবিষ্যৎতে কিয়েভ গঠনের জন্য অশনি সংকেত। তবে, আঞ্চলিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ তম নবীন সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত প্রাপ্তি হিসেবে দাবি করতেই পারে ইউক্রেন । যদিও ইতিমধ্যে ন্যাটোর সামরিক জোটে যোগ দেওয়ার দিবা স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে দিয়েছে কিয়েভকে। কার্যত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কিংবা সহানুভূতি অর্জন সামান্য অর্জন হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্যদিকে, ইউক্রেনকে যারা সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যুদ্ধকে জিইয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদেরে কপালে ভালো কিছু জোটে নি। বরং বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানকে বিদায় নিতে হয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বিদায় নিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধান মন্ত্রী স্ক্যাট মরিসন। যিনি বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা অ্যান্থনি আলবানিজের কাছে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। বলা বাহুল্য, মরিসন রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতের পর থেকে কিয়েভের পক্ষে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন।

শুধু তাই নয়, ইতালি সরকারের পতন ঘটেছে। ফ্রান্সের রাশিয়া সমর্থিত বিরোধী দল শক্তিশালী হয়েছে। বেলজিয়ামে STOP NATO স্লোগানে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। যা ব্রাসেলস এর ইতিহাসে নজীর বিহীন ঘটনা। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন লক্ষণীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে। ইতিমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের সামরিক সহযোগিতার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। গবেষণা বলছে, জো বাইডানের জনপ্রিয়তা ৪০ শতাংশের নিচে নেমেছে। কার্যত, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান জনগণ যে, যুদ্ধ বিগ্রহের বিপক্ষে তা অনুমেয়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, অভ্যন্তরীণ সমস্যা যেমন সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ, মুসলিম বিদ্বেষ হ্রাস। সেইসঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, হেইট ক্রাইম প্রভৃতি ব্যর্থতা আড়াল করতে জো বাইডেন সরকার ইউক্রেন ইস্যুকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনে ইউক্রেন ইস্যুকেই পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে জো বাইডেন সরকার। তবে নিকট ভবিষ্যৎতে সময় বলে দিবে, দেশটির জনগণ যুদ্ধের বিপক্ষ নাকি অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের রায় দিবে! মোদ্দা কথা, ইউক্রেন যুদ্ধে যেসব দেশ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে। অথবা কিয়েভের পক্ষে সাফাই গেয়েছে তাদেরকে কড়া মাশুল গুনতে হয়েছে।

অপরদিকে,ঠিক বিপরীত চিত্র রাশিয়ার রাজনীতি অঙ্গনে। গবেষণার তথ্যমতে, বর্তমানে মস্কোতে পুতিনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এমুহূর্তে ক্রেমলিনের ক্ষমতার মসনদে অপ্রতিরোধ্য পুতিন। ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের কঠিন সময়ে রাজনীতি এবং অর্থনীতির কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে পুতিন সরকার। যেখানে পশ্চিমাদের সহস্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে দেশটির অর্থনীতির চাকা। মূলত, পশ্চিমাদের অর্থনীতি দুর্বল করার কৌশল এখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বরং রাশিয়ার ওপর গ্যাস, তেল নির্ভরশীলতা ইউরোপ বেশ বিপাকে রয়েছে। ইতিমধ্যে পোল্যান্ড দেশটি বনায়ন কেটে জ্বালানি জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। এমন সিদ্ধান্ত পরিবেশে জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন পরিবেশবাদীরা। অপরদিকে, রাশিয়াকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে দিবাস্বপ্ন পশ্চিমা বিশ্ব দেখেছিল তা অধরাই রয়ে গেছে। তবে এ কথা ঠিক যে, ইউরোপের সাথে মস্কো সম্পর্কের বড় ধরনের ফাটল রেখা তৈরি হয়েছে। এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্রেমলিনের অর্থনীতি।

ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে পশ্চিমা বিশ্বের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার জালে জর্জরিত মস্কো। যার ফলে অংশীদার হিসেবে চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে রাশিয়া । গবেষণার তথ্যমতে, মস্কো ইউক্রেনে আক্রমণের পর সবচেয়ে বেশি জ্বালানি ক্রয় করেছে বেইজিং। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই সংঘাতের জন্য চীন ন্যাটোর উসকানিমূলক পদক্ষেপকে দায়ী করেছে। সেইসাথে ইরান, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে ক্রেমলিন। অপরদিকে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা যেসব দেশ সম্পৃক্ত হয়েছে তাদেরকে অবন্ধুসুলভ দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে পুতিন প্রশাসন। উল্লেখ্য, অবন্ধুসুলভ দেশগুলো রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে জ্বালানি ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছে। মূল কথা, পুতিনের দাবার চালে অসহায়¡ ইউরোপের অনেক দেশ আজ বাধ্য হয়ে রুশ মুদ্রায় লেনদেন করছে।

কার্যত, মস্কো-কিয়েভ সংঘাত কতদিন চলবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে, পশ্চিমা বিশ্ব যতদিন ইউক্রেনে রসদ সরবরাহ করবে তত বেশি লম্বা হবে যুদ্ধের পরিধি। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিয়েভ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু কিংবা যুদ্ধে কিয়েভকে জয়ী করতে অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব যে ধরনের স্ট্র্যাটিজি নিয়েছে তা অনেকাংশ অকার্যকর। এমনকি ইউরোপের গ্যাস রপ্তানির বিকল্প বাজার তৈরি করেছে রাশিয়া। স্মরণযোগ্য, পুতিন ক্ষমতা গ্রহণের পর একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। সেইসাথে, প্রতিটি যুদ্ধে মস্কো তার জয় নিশ্চিত করেছে। সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে জয় লাভের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, হেনরি কিসিঞ্জার একজন ঝানু কূটনীতিবিদ। কিয়েভের জন্য তাঁর পরামর্শ বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কঠিন বাস্তবতার অংশ বিশেষ। সুতরাং আজ অথবা আগামীকাল এই সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে ইউক্রেনকে অবশ্যই রাশিয়া দখলকৃত ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে হতে পারে। এই নিদারুণ বাস্তবতা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যতদ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই দ্রুত বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে বলেই অনেকের ধারনা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
রাশিয়া-ইউক্রেন,দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close