মো. আতিকুর রহমান

  ২১ আগস্ট, ২০২২

অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্ত হোক ঢাকা

প্রতীকী ছবি।

বর্তমানে কর্মের টানে দেশের অধিকাংশ জনগণ ঢাকামুখী। দেশের প্রধান প্রধান অফিস, আদালত, শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রধান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায় বিভিন্ন পেশার মানুষ মূলত কর্মের তাগিদেই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে নগরীতে বসবাস এবং মানবেতর জীবনযাপন করছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তাদের অধিকাংশরই নিজ বাড়িতে থাকার ঘরগুলো মূলত শূন্যই পড়ে আছে। যদি পরিবহন খরচ সহনীয়পর্যায়ে থাকত, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হতো এবং চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহনের ব্যবস্থা থাকত তাহলে হয়তো এসব মানুষ নিজ বাড়িতে তাদের কর্মটি করে খেতে পারত। এতে ঢাকা শহরে ভূমিদস্যুদের ভূমি দখলের প্রবণতা রোধ পেত, প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করে ফ্ল্যাট বিক্রি ও বাসাভাড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকাবাসীর বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করার ইচ্ছাও কমে যেত এবং বর্তমানে শহরের বিভিন্ন স্থানের লাগামহীন বাড়িভাড়ার হাত থেকে নগরবাসী রক্ষা পেত। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি ঢাকার পাশের এলাকা থেকে মানুষকে অফিস টাইমে আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ করে ট্রেনসহ অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম গণপরিবহন সেক্টরকে আরো কার্যকর ও নিরাপদ করা সম্ভব হতো, রাস্তাঘাটের নাজুক অবস্থার মানোন্নয়ন করা যেত এবং যোগাযোগের জন্য টিকিটপ্রাপ্তি সহজলব্ধ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য বেশি করে ট্রেন ও গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা যেত এবং সেগুলোকে মানসম্মত ও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সময়োপযোগী করা যেত; তাহলে হয়তো ঢাকার ওপর থেকে জনগণের চাপ কিছুটা কমত। যদিও বর্তমান সরকার যোগাযোগ খাতে বিশৃঙ্খলা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে প্রয়োজন সংশ্লিষ্টদের অধিক সদিচ্ছা।

যদিও স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুমারিতে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখন এই শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। প্রতিদিন বাড়ছে ঢাকার জনসংখ্যা। জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাজধানী ঢাকায় জনদুর্ভোগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে ১ হাজার ৭০০। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। এত মানুষের আবাসন, কর্মসংস্থান সবই হয়েছে ঢাকায়। এতে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগরী। এখন সরকার ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার সুফল পাচ্ছে না জনগণ। উল্টো নগরে যানজট, বায়ুদূষণ, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন সমস্যা বেড়েই চলছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, ছোট্ট এ ঢাকায় মানুষ এভাবে আসতে থাকলে এ শহরের সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যার পরিমাণও বাড়বে। এখন ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিংসেবাসহ অনেক ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সেবাব্যবস্থা, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধান করতে হবে। বিভিন্ন আঞ্চলিক শহরে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হবে। যাতে ঢাকার বাইরে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসার প্রয়োজন বোধ না করেন। সংশ্লিষ্টদের অতিদ্রুত ঢাকায় অবস্থিত প্রধান অফিসগুলোকে যদি বিকেন্দ্রীকরণ করা যেত, গ্রামীণ শিল্প-কলকারখানা তৈরি করে নিত্যনতুন কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করা সম্ভব হতো, কৃষি ও গবাদিপশু পালনের ওপর জোর দেওয়া যেত, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনব্যবস্থাকে আরো বেশি কার্যকর করা যেত, তবে ঢাকায় বিরাজমান জনগণের চাপ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনার পাশাপাশি এ শহরকে পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো।

বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি; প্রতি বছর শহরের সব স্থানেই লাগামহীন বাড়িভাড়া বৃদ্ধি; নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি; গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্য বৃদ্ধি তথা এর প্রকট সংকট; যা প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহন, চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ঢাকায় বসবাসরত মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের জনগণ বর্তমান আয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের অধিকাংশেরই ধার-কর্জনির্ভর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে সংসারের ভরণ-পোষণের দায়ে ব্যাংকে গচ্ছিত সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। কেউ কেউ ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে কার্ডের প্রদত্ত অর্থ খরচ করে এখন বেতনের টাকা থেকে মাসে মাসে এসব কার্ডের চক্রবৃদ্ধি সুদের ঘানি টানতে টানতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন। এসব মানুষ প্রতি মাসে বেতন বাবদ যা উপার্জন করছে তার প্রায় অর্ধেকের বেশি অর্থ মাসের প্রথম সপ্তাহেই বাড়িভাড়া বাবদ বাড়িওয়ালাকে দিয়ে আসতে হচ্ছে। সেই বাড়িভাড়া দিতেও চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন অনেকে।

এদিকে বাড়িভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাদের বিভিন্ন শর্তের ফুলঝুরি তো রয়েছেই, যেমন রাত ১১টার পর বাড়িতে ঢোকা যাবে না অর্থাৎ পরে এলে গেট বন্ধ, বাসাভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রিম ন্যূনতম চলতি মাসসহ তিন মাসের বাসাভাড়া প্রদান, পরিবারের বেশি সদস্য থাকা যাবে না, ভাড়াটিয়া চাকরিজীবী কি না, ভাড়া বাড়িতে অতিথি বেশি রাখা যাবে না, প্রভৃতি বিষয় সহ্য করে এসব মানুষ বাড়িভাড়া দেওয়ার পর বাদবাকি যে অর্থ তাদের হাতে অবশিষ্ট থাকছে তা দিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ, চিকিৎসা ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটানো সত্যিই এই দুর্মূল্যের বাজারে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তার পরও প্রতিদিন পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি ঢাকাবাসীকে আরো নাকাল করে ফেলেছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনমুখী শিল্পের কাজসহ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ভীষণভাবে বিঘ্ন হচ্ছে।

প্রয়োজনীয় গ্যাস ও পানি না থাকার কারণে ঢাকাবাসী বর্তমানে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, পাশাপাশি রয়েছে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি। বর্তমান আয়ে এ ধরনের পরিস্থিতিতে যদি পরিবারের কেউ অসুস্থ হয় তবে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার মান একেবারে নেই বললেই চলে। তাই এসব মানুষকে বাধ্য হয়েই বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি, চিকিৎসকের ফি বৃদ্ধি এবং তাদের অবৈধ অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে রোগ নির্ণয়ের জন্য নিজেদের তালিকাভুক্ত প্যাথলজিতে রোগীদের পাঠিয়ে তাদের অনেকে পাঁঠার বলি বানানো। ফলে ঢাকাবাসী আর্থিকভাবে বর্তমানে আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পরিবারে অতিথির আগমন তো রয়েছেই। অতিথি আপ্যায়ন করতেও এসব মানুষের ধার-কর্জের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা মাসের বেতনের ওপর প্রভাব পড়ছে। কিন্তু এসব মানুষ যদি নিজ এলাকায় কর্ম করে খাবার সুযোগ পেত, তবে নিজ বাড়িতে থেকে হয়তো তাদের এত অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। পাশাপাশি পানিরও তেমন সংকটে পড়তে হতো না, বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে অন্তত খোলা জায়গা পাওয়া যেত।

মানুষের কাছে দেশের মোট প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই, তারা চায় দ্রব্যমূল্যের সহনীয় পরিস্থিতি। তারা চায় লাগামহীন বাড়িভাড়া রোধকল্পে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন। যোগাযোগব্যবস্থার অবনতি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট থেকে চায় স্থায়ী মুক্তি। তারা চায় দেশে মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কথায় না কাজে সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। এই সামান্য চাওয়ার বিপরীতে মূল্য বৃদ্ধির খড়্গ পড়ছে মূলত জনগণের ঘাড়ে। যার প্রভাব মূলত নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে আরো অসহনীয় করে তুলবে। এজন্য সরকারকে বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থা অর্জনে খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় সেবার মান বাড়াতে হবে, জনগণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে হবে। আসন্ন রমজানে বাজারব্যবস্থা আরো সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। মূলত এ বিষয়গুলো প্রতিকারে সরকারের উদার দৃষ্টি এবং সেবার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের আরো কঠোর হওয়া জরুরি।

সরকারকে জনগণের আস্থা অর্জনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে, চিকিৎসার নামে চিকিৎসকদের দ্বারা রোগীদের পাঠার বলি বানানোর প্রবণতা রুখতে হবে, শিক্ষার নামে শিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, বেতন কাঠামো ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে, পাশাপাশি বছর বছর বাড়িভাড়া বৃদ্ধি রোধকল্পে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ধীরে ধীরে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিল্প-কলকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যত দূর সম্ভব স্থানান্তর করতে হবে ঢাকার বাইরে। পবিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে একে অধিক জনসংখ্যার চাপ থেকে অতিদ্রুত মুক্ত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকাবাসীর জীবন-জীবিকার মান উন্নত ও দ্রব্যমূল্য সহনীয়পর্যায়ে রাখতে সরকারকে ওই বিষয়গুলোর দিকে আরো নজর দিতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি। [email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
অতিরিক্ত চাপ,মুক্ত হোক ঢাকা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close