নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৮ মার্চ, ২০২১

করোনা মোকাবিলায় নারী নেতৃত্বের ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা বহিঃপ্রকাশ হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটিকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পটভূমি হচ্ছে এই দিনে আমেরিকায় ঘটে এক আন্দোলন। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন। সেদিন বেতনবৈষম্য, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা আর কাজের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নারীরা এক জোট হলে তাদের ওপর কারখানা মালিকরা আর তাদের মদদপুষ্ট প্রশাসন দমন-নিপীড়ন চালায়।

অর্ধশতাব্দীর পর ১৯০৮ সালে জার্মানিতে এ দিনটির স্মরণে প্রথম নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭ দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকেই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানালে এরপর থেকে সারা বিশ্বব্যাপী দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে জন্মশতবার্ষিকী এবং প্রাণঘাতী কোভিড-সংক্রমিত বিশ্বে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘কোভিড-১৯ আক্রান্ত পৃথিবীতে সম ভবিষ্যৎ অর্জনে নারী নেতৃত্ব’। প্রাণঘাতী এই মহামারি আক্রান্ত পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় নারীসমাজ বিশেষ করে হাসপাতালের সেবিকারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে সম্মুখ সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুধু সেবা নয়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ, সাহস ও শক্তি জুগিয়ে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে নারীসমাজ। করোনার কারণে যখন অফিস-আদালত, দোকানপাট, যানবাহন ও হোটেলরেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল, কর্মহীন হয়ে কোটি কোটি মানুষ অনাহার ও অর্ধাহারে জীবনযাপন করছিল, তখন এই নারীসমাজই জীবনের মায়া ত্যাগ করে খাদ্যসহায়তা নিয়ে অনাহারী মানুষের পাশে দাঁড়ান দৃঢ়তার সঙ্গে। তারা তৈরি খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দেন কর্মহীন যানবাহন চালক, কৃষিশ্রমিক এবং দিনমজুরদের হাতে।

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের নারী নেতৃত্বাধীন কিছু দেশ যে সফলতা দেখিয়েছে, তা সত্যই প্রশংসার দাবিদার। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা যেখানে মহামারি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে করোনা মোকাবিলায় সফল হচ্ছেন নারী সরকারপ্রধানরা। এসব নারী নেতৃত্বাধীন দেশ করোনা মোকাবিলার কৌশল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নেতৃত্বের কয়েকটি সাধারণ গুণাবলির কারণেই তারা করোনা ঠেকাতে সক্ষম হয়েছেন। এসব গুণাবলির মধ্যে রয়েছে তথ্যের স্বচ্ছতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নাগরিকদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। করোনা মহামারির মতো এই বৈশ্বিক সংকটের সময়ে দক্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত রেখেছে জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী সাহসী পদক্ষেপ এবং যোগ্য নেতৃত্বে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, যার ফলে দেশটিতে করোনার মতো মহামারিকালেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়নি। খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়নি। কল-কারখানা ও মাঠে-ময়দানে উৎপাদন প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়েনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে (৫ এপ্রিল ২০২০) ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে টাকার অঙ্কে এটাই সবচেয়ে বড় প্রণোদনা। এই বিশাল প্রণোদনার মধ্যে শিল্পঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা, গরির মানুষের নগত সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা। অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, এ ছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সাংবাদিক ও শিক্ষকসমাজের সদস্যরাও বাদ পড়েননি।

ইউনাইটেড ইনস্টিটিউট অব পিচ তাদের একটি প্রতিবেদনে বলেছে, করোনার মতো মহামারি ঠেকাতে নারীর অভিজ্ঞতা ও তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তাবিকপক্ষে করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের নারী নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর দিকে তাকালে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। নারী নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর এই সফলতার দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন উঠেছে; হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষ নেতৃত্বের জায়গা কি এবার ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে? শুধু করোনা পরিস্থিতি নয়, কয়েক দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে, নেতৃত্বের দিক দিয়ে নারী নেতৃত্ব যথেষ্ট সফল এবং কঠিন ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যোগ্য নেতৃত্ব, সারা বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতিতে হিলারী ক্লিনটনের দাপট এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের দৃঢ়তা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে ভারতে মমতা ব্যানার্জির সাহসিকতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সারা ভারতবর্ষে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে কীভাবে নিজের রাজ্যকে সঠিক একটা পথ দেখানো যায়, তার অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন তিনি। তার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের তাবৎ মানুষকে সাহস জোগাচ্ছে এই কঠিন সময়।

করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে সফল নেতৃত্বের জন্য ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ফ্রেদেরিকসেন, আইসল্যান্ডের ক্যাটরিন, নরওয়ের আর্নাসলবার্গ, তাইওয়ানের সাইইং ওয়েন এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ফিনল্যান্ডের সানা মার্টিন প্রশংসিত হচ্ছেন, যারা সবাই নারী।

অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিন্তু করোনা মোকাবিলায় সমালোচিত ও আপাত ব্যর্থ নেতা হিসেবে সমালোচিত হচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন, চীনের শি জিনপিং এরা সবাই পুরুষ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিথ্যা জাতীয়তাবাদের আগুনে ঘি ঢেলে তান নগ্ন রূপটি প্রকাশ করেছেন। এই মহামারিকালে নরেন্দ্র মোদির প্রদীপ প্রজ্বালন ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

শুধু নেতৃত্বের দিক দিয়ে নয়, চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এ সময় নারীর ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো। ভয়াবহ করোনা সংকটকালে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় জরুরি সেবাদানে নারীর ভূমিকাই অগ্রগণ্য। চীনসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নারী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা দিন-রাত এক করে রোগীকে সেবা দিয়েছেন, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে একটি সংবাদ ব্যাপক ভাইরাল হয়েছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন সেবিকা করোনা রোগীর সেবার জন্য হাসপাতালেই থাকছেন, তার ছোট মেয়েটিকে এক আত্মীয় দূর থেকে তাকে দেখিয়ে নিচ্ছেন। কী অসহনীয় কষ্ট!

তাই সার্বিক বিবেচনায় এটা বলা মোটেও বাহুল্য হবে না যে, করোনা উত্তর পৃথিবীতে নারী নেতৃত্বে নারীর ক্ষমতায়ন সুখ ও সমৃদ্ধি আনবে বলে প্রতীয়মান হয় । আমরা যদি এ সময় পরিবারগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে, করোনার এই মহামারির সময়েও নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন।

এই দুর্যোগে নারীই পরিবারের হাল ধরেছেন আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাবই নয়, সবক্ষেত্রেই নারীকেই নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মনোবল অটুট রাখতে, আপৎকালীন সাংসারিক খরচ কমিয়ে আনতে সন্তানের যত্নআত্তি ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই নারীকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ময়মনসিংহে একজন চাকরিজীবী নারীর স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তার শবদাহে আত্মীস্বজনরা মৃত্যুভয়ে না এলেও ওই ব্যক্তির স্ত্রীই স্বামীর মুখাগ্নি করে মানবসেবা ও ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

অন্যদিকে পুরুষরা বেড়াচ্ছেন সহিংসতা করে। করোনাকালে তারা পারিবারিক সহিংসতার ঘাঁটি হয়ে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন। পরিবারে নারীর এই যোগ্য ভূমিকা ও পুরুষের বীভৎসরূপ মূল্যায়ন করে পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে ভাবতে হবে—সংসারে নারী এখন থেকে মুখ্য নেতৃত্বে থাকবেন কি না? কেননা, করোনার এই সংক্রমণকালে এটা প্রমাণিত কী রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব, কী সংসার, সবখানেই নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। সঠিক সময়ে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন নারীরাই।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিমিটেড

[email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
করোনা মোকাবিলা,নারী নেতৃত্ব,নারী দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close