রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৪ জানুয়ারি, ২০২১

চলমান সংকট বনাম অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা

বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট ২০২০ সালে মন্দায় রূপ নিচ্ছে! ইতিপূর্বেকার আভাসে এমনটি বলা হলেও সর্বশেষ মধ্যপ্রাচ্য সংকটে মন্দার আঁচে হাওয়া লেগেছে এমন মন্তব্যই করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ দিয়ে শুরু হওয়া সংকট নানা কারণে আরো ঘনীভূত হচ্ছে এবং দ্রুতই এর প্রভাব পড়তে পারে ধনী-দরিদ্র দেশগুলোতে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয় মন্তব্য করে কেউ কেউ বলেছেন, এখনি সতর্ক হতে হবে। ২০১৭ ও ১৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতি সুসংহতই ছিল বলা যায়। পরবর্তী কালে তাতে চিড় ধরে এবং গত বছরই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সতর্ক করে বলেছিল, চীন-মার্কিন বাণিজ্য বিরোধের সমাধান না হলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হবে। যার ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো প্রায় সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারণার চেয়ে কম হওয়ার পূর্ভাবাস দিয়েছে।

এমনকি স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশকিছু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু দুর্বল সুশাসন, প্রতিকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ ও নাগরিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং তাদের অবশ্যই ১৯৪৫ পরবর্তী বহিরাগত উন্নয়ন অর্থায়নের দৃষ্টান্তগুলোও ভেঙে বের হতে হবে; যা মূলত সাউথ এশিয়া দ্বারা পরিচালিত ও তাদের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে গঠিত। এরা মনে করেন, সবকিছু সম্পর্কে তারাই অনেক ভালো জানে। দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের হিতোপদেশ শুনতে বাধ্য হয়েছে। অপরদিকে ধনী দেশগুলো যখন মহামারি-পরবর্তী অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন কৌশলের দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছে, উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো ততক্ষণে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। অনুমান করছে ২০২০ সালে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বহিরাগত বেসরকারি অর্থপ্রবাহ ৭০০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে, যা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক সংকটের ফলে সৃষ্ট ৬০ শতাংশ প্রভাবের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্তই উদীয়মান বাজারগুলো থেকে নন-রেসিডেন্ট পোর্টফোলিও আউটফ্লোর পরিমাণ ছিল মোট ৮৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ওইসিডি আরো অনুমান করছে, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ বছরে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে, উন্নয়নশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা আরো কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জাতীয় প্রবণতা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর জন্য একটি গুরুতর অবস্থার ইঙ্গিত দেয়, বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে যারা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এমনকি কোভিডের আঘাত আসার আগে থেকেই অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতিই সাহায্যনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে স্বনির্ভরতার দিকে টেকসই স্থানান্তরের উপায় খুঁজছিল। ২০১৮ সালে রুয়ান্ডা তার দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পকে উচ্চতর মূল্যযুক্ত পোশাক উৎপাদনে উৎসাহিত করতে সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাক রপ্তানি নিষিদ্ধ করে; দেশটির শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা স্থগিতের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। এদিকে গত বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি ও এফডিআই আকর্ষণে সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রকল্পগুলোয় সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য সরকার ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ দেয়।

জনস্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে কাঠামোগত ধাক্কা দেওয়ার পাশাপাশি বড় ধরনের বিড়ম্বনায় ফেলেছে কোভিড-১৯। মহামারির কারণে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল অনুমান করছে যে, ২০২০ সালে বৈশ্বিক জিডিপি সংকুচিত হবে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে আশ্চর্যজনক হলেও ধারণা করা হচ্ছে, চলমান সংকট উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিতে যেতে পারে। এর আংশিক কারণ হলো, উন্নত দেশগুলোয় মহামারিটি সাধারণ স্বাস্থ্যগত প্রভাবের মাত্রাকে যতদূর সম্ভব বিপর্যস্ত করে তুলেছে। উন্নততর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা ও শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা জাল থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর জনগণ দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভারতের অবস্থান ১১২তম, এদিকে এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৩৭তম। অথচ লাখ হিসাবে ভারতে ৬ হাজার ৪০০ জন কোভিডে আক্রান্ত হলেও আমেরিকায় এর সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেশি। কিছু উন্নয়নশীল দেশ যেমন ভিয়েতনামে করোনা শুরুর প্রথম দিকেই কঠোর পরীক্ষা, শনাক্তকরণ ও কোয়ারেন্টাইন জোরদার করা হয়। উন্নত অনেক দেশও যা করতে সক্ষম হয়নি।

এমনকি দরিদ্র দেশগুলোর ভুল রিপোর্ট ও ভুল তথ্য প্রদান সম্ভাবনার বিপরীতে উন্নত অর্থনীতির আপেক্ষিক কর্মক্ষমতার বিষয়টি এখনো একটি প্যারাডক্স। বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, উন্নয়ন সহায়তা ও মানবিক সহায়তা অগত্যা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করে না। ওইসিডির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ থেকে ৯৪ শতাংশ উত্তরদাতাই বিশ্বাস করেন না যে, মানবিক সাহায্য তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করে। মানুষ দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা নয়, আর্থিক স্বায়ত্তশাসন চায়। যদিও উন্নয়ন সহায়তার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের বিষয়গুলো পুরোনো। সমালোচকরা দাবি করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য ধনী রাষ্ট্রগুলো একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং রপ্তানি বিলের বেশির ভাগ সুবিধা যাতে দাতাদের ঝুলিতে যায়, তা নিশ্চিত করতে প্রায়ই বিভিন্ন শর্তারোপ করে। তবে উন্নত অনেক রাষ্ট্রই মহামারিবিষয়ক অসামঞ্জস্য প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের স্বাভাবিক ক্ষমতার অনেকটাই খুইয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে ই-কমার্সকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে মহামারি-পরবর্তী পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে ডিজিটালাইজেশন। বিশ্বজুড়ে উৎপাদনকারীদের জন্য যা দুর্দান্ত একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। চলতি বছরের আগস্ট নাগাদ বাংলাদেশের ই-কর্মাস সেক্টরের বৃদ্ধি ঘটেছে ২৬ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোয়ও একই প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষ করে দ্রুত বর্ধমান ডিজিটাল অর্থনেতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে আয়ের জন্য করনীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা কাজটি করতে পারে।

বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে জিডিপিতে নিম্নস্তরের কর রাজস্বের পরিমাণ ১০ থেকে ২০ শতাংশ, উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় পরিমাণটি ৪০ শতাংশ। স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও শিক্ষার মতো জনবিষয়গুলোয় সরকারের বিনিয়োগ সীমাবদ্ধতা উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামনে স্বনির্ভর হওয়ার অনেক বেশি সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতে, মহামারি চলাকালীন পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য তুলনামূলক কম সংকুচিত হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো, সাধারণত মন্দার সময় উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলো অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি স্বল্পমূল্য সংযোজনীয় ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ওপর তাদের নির্ভরতা থেকে উদ্ভূত। ভিয়েতনামের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট। মহামারিজুড়ে দেশটির উৎপাদন কার্যক্রম চালু রয়েছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে আঞ্চলিক অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় তাদের দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশসহ ট্রান্স হিমালয় অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আর স্থিতি শীলতার আশা করে চীন। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীন, ভারত আর অন্য দেশগুলোর যে জরুরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ রয়েছে, সেটা ট্রান্স হিমালয় অঞ্চলে কোনো যুদ্ধ বাধতে দেবে না। চীন ভারতের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সহযোগিতার সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

চীন আশা করে যে, আঞ্চলিক আধিপত্যের ধারণা বাদ দিয়ে ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করবে। এ অঞ্চলের সবগুলো দেশের মৌলিক স্বার্থেই এটা করা উচিত। পশ্চিমা মিডিয়ার এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের পেছনে মূলত মার্কিন কর্তৃপক্ষের মদদ রয়েছে। আসলে বিশ্বে নিজেদের আধিপত্যের অবস্থানটা ধরে রাখতে, উদীয়মান বাজার অর্থনীতির উত্থানকে ব্যাহত করতে এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে অনুন্নত অবস্থায় রাখার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এই জনমত তৈরির যুদ্ধ শুরু করেছে। আসলে একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা, পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতিমালার বাস্তবায়ন, আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে অংশগ্রহণের মাত্রা ও দীর্ঘমেয়াদে সুশাসন টিকে থাকার সম্ভাবনার ওপর প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ নির্ভর করে। বৈরী বৈশ্বিক পরিস্থিতি, উন্নত দেশগুলোর সংরক্ষণবাদী মনোভাব ও ভৌগোলিক-কৌশলগত সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
স্বনির্ভরতা,অর্থনৈতিক সংকট
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close