reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১২ জানুয়ারি, ২০২১

প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতি

বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা স্বপ্নিল গতিতে আধুনিকায়ন হয়েছে। গত এক দশকের ব্যবধানে প্রযুক্তির জাদুর স্পর্শ শহরের পাশাপাশি আবহমান বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপথকেও রাতারাতি পরিবর্তিত করে উন্নত দেশের সমান সুযোগ-সুবিধাযুক্ত লোকালয়ে পরিণত করেছে। করোনাভাইরাসের দুর্যোগের সময়ে বাংলাদেশের আপামন জনসাধারণ তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে জীবনধারা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বেশির ভাগেরই কোনো না কোনো পর্যায় বাংলাদেশে ব্যবহার হয়ে থাকে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে। থ্রি-জি ফোর-জি পেরিয়ে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক যেমন চালুর দ্বারপ্রান্তে; তেমনি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট এখন মহাকাশে সক্রিয় থেকে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি কাজ বৈদেশিক নির্ভরতা মুক্ত করে সুসম্পন্ন করে চলছে। বাংলাদেশের মতো বিশে^ আর কোনো উন্নয়নশীল দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এত স্বল্প সময়ে নিজস্ব পরিকল্পনায় ডিজিটাইজ হয়েছে।

অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে ত্বরিত সুফলও পেয়েছে। বর্তমানে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল শেষে এ আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। শুধু শহরেই নয়, বরং জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কয়েকটি অনুষঙ্গের ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করে চলেছে। সে অনুষঙ্গগুলো হলো (ক) কানেকটিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো (খ) মানবসম্পদ উন্নয়ন (গ) আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন (ঘ) ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য।

1সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সহযোগী হয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার জানা যুগোপযোগী দক্ষ কর্মী তৈরি করাই প্রধান কাজ। আমাদের দেশের জেনেক্স ইনফোসিস, সিনেসিস আইটি, ব্রেইনস্টেশন, ইক্সোরা, বিজেআইটি, প্রাইডসিস, সিসটেক ডিজিটাল, ব্র্যাকআইটি, মাইসফট, মিডিয়াসফট, ইরা ইনফোটেক, নেসেনিয়া, টিকন, এনআইটিএস, বিভিক্রিয়েটিভস, টেকনোভিস্তা, আমরা টেকনোলজিস, বি-ট্র্যাক টেকনোলজিস, এডিএন টেকনোলজিসের মতো আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করছে। ২০১৪ সালে এটি কারনির তালিকায় ৫০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩২। ই-গভর্ন্যান্সের জাতীয় ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১১৫ নম্বরে। তথ্যপ্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে আইটিইউ অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড, গার্টনার এবং এটি কারনিসহ বেশ কিছু সম্মানজনক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যালায়েন্সের (উইটসা) মহাসচিব জেমস পয়জ্যান্টস বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশ ভালো করছে এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই উইটসা ঢাকাকে বেছে নিয়েছে বিশ্ব সম্মেলন করার জন্য। যেকোনো দেশের সফলতার মূল বিষয় হলো নেতৃত্ব। বাংলাদেশের তা আছে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফরম কোরসেরার বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স ২০১৯’ (জিএসআই) অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ।

দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা বর্তমানে পুরোপুরি দৃশ্যমান। ১০ বছর আগে কেউ কল্পনাও করেনি ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষ ইন্টারনেট-সেবা পাবে। ২০০৮-এ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২৪ লাখ, বর্তমানে প্রায় ১০ কোটি। বিশ্বব্যাপী বিপিও খাতের বাজার প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বিপিও ব্যবসার বাজার গত ১০ বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০০৫ সালে যে ব্যান্ডউইডথের দাম ছিল ৭৫ হাজার টাকা, সরকার এখন তা ৪০০ টাকায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে বিপিও খাতে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এরই মধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইটসহ কয়েকটি বড় প্রাপ্তি বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।

বাংলাদেশ প্রযুক্তি বিশ্বে অর্জন করে নিয়েছে নিজেদের একটি সম্মানজনক স্থান। বিশেষজ্ঞরা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এই উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আখ্যায়িত করছেন ডিজিটাল নবজাগরণ হিসেবে। দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। বড় পরিবর্তন এনেছে উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের যাতায়াতেও সুবিধা হয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বাড়ায় নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি হয়েছে। সারা দেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কানেকটিভিটি স্থাপনের জন্য বাংলা গভর্নেট ও ইনফো সরকার-২ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ফলে সরকারের ৫৮ মন্ত্রণালয়, ২২৭ অধিদপ্তর, ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা ও উপজেলার ১৮ হাজার ৫০০টি সরকারি অফিস নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। ৮০০ সরকারি অফিসে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম, ২৫৪ অ্যাগ্রিকালচার ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টার (এআইসিসি) ও ২৫ টেলিমেডিসিন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা যাতে অফিসের বাইরে থেকেও দাপ্তরিক কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পাদন করতে পারেন, সেজন্য তাদের মাঝে ২৫ হাজার ট্যাব বিতরণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের বিদ্যমান জাতীয় ডেটাসেন্টারটির সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সেন্টারটির ওয়েবহোস্টিং ক্ষমতা ৭৫০ টেরাবাইটে উন্নীত করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য বিসিসির এলআইসিটি প্রকল্পের আওতায় একটি বিশেষায়িত ল্যাব এবং একটি স্পেশাল সাউন্ড ইফেক্ট ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়েছে। কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক ও খুলনায় শেখ হাসিনা হাইটেক পার্কে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে প্রযুক্তিগত নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সরকার ৬০০ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছে। ২০০ বছরেরও অধিককাল ধরে প্রচলিত বিচারিক কার্যক্রমের ডিজিটালাইজেশন করেছে সরকার। সাইবার হয়রানি রোধে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এই কর্মসূচির আওতায় একটি হেল্পলাইনও চালু করা হয়েছে। পাঠাও-উবারের মতো স্টার্টআপ চালু হয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক স্টার্টআপ কোম্পানিকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, অধিকতর উন্নত জনসেবা প্রদানের জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। নিউজের জন্য এখন আর পরদিনের ছাপা পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতি মুহূর্তে পত্রিকা-টিভির অনলাইন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তাৎক্ষণিক ঘটনাবলি ও তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে। করোনাকালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রযুক্তির ব্যবহারে চরম উৎকর্ষতা দেখাতে পেরেছে আর শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও অনলাইনমুখী হচ্ছে। গড়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। এর বাইরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সার। দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছেন সফটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তারা। এ খাতে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় আসছে। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আরেক বড় অগ্রগতি। এ ছাড়া ই-কমার্স ও এফ-কমার্স খাত দেশে প্রসারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এরমধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্যতম একটি খাত বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও। খাতটিতে কাজ করছেন ৩৫ হাজার তরুণ-তরুণী।

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেপথ্য নায়ক ও নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া আইসিটি বিপ্লবের স্থপতি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। ১২ বছর ধরে দেশের সব মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা, তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সরকারের ডিজিটাল সেবাগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আইসিটি শিল্পে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশকে ডিজিটাল জগতে নিয়ে যাওয়ায় বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে সম্প্রতি তিনি আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে উন্নত বিশে^র কাতারে পৌঁছে যাবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/ জিজাক

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বাংলাদেশ,প্রযুক্তি
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close