হাসান শান্তনু

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

শিক্ষার বৈষম্য বাড়ছে

আজ শিক্ষা দিবস

শিক্ষা খাতে বাড়ছে বৈষম্য, বাড়ছে বাণিজ্যিকীকরণ। দেশে রয়েছে তিনমুখী শিক্ষা—সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষা। এছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষা ব্যয়ে রয়েছে বিস্তর ফারাক। বেসরকারি খাতের শিক্ষার জন্য চড়া মূল্য গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। পাবলিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফল অর্জনের তীব্র প্রতিযোগিতায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে কোচিং ব্যবসা। সাত বছর আগে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন কাজও চলছে ঢিমেতালে। ফলে একটি সমতাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও সম্প্রসারণশীল শিক্ষাব্যবস্থা এখনো দেশে পুরোপুরি চালু হয়নি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এমনই অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রোববার ১৭ সেপ্টেম্বর দেশে পালিত হচ্ছে মহান শিক্ষা দিবস। এবারও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটিকে পালন করা হবে।

১৯৬২ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা ও বাবুলসহ নাম না জানা অনেকে। তাদের স্মরণে দিনটিকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ, বিজয়, গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীক এ শিক্ষা দিবসের এবার ৫৫তম বার্ষিকী। এই আন্দোলনের ৪৮ বছর পর ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’। এরআগে বিভিন্ন সময়ে আরো নয়টি শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও সেগুলোর কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি। আবার নতুন এ নীতির বাস্তবায়ন কাজেও গতি আসেনি।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, শিক্ষায় বর্তমানে মৌলিক পার্থক্য তেমন হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষা পাক আমলে বাধ্যতামূলক ছিল না। শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ ও পুঁজিবাদী বিকাশ ঘটেছে। আসলে রাষ্ট্র বদলালেও ভেতরে মনোভাব একই রয়ে গেছে। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষা—দেশে তিনধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, শিক্ষায় বাণিজ্য আজ একটি ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে, ভালো মানের স্কুল কম, তাই এই কম স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। স্কুলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা জরুরি।

সরকারি হিসাব ও দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এ মুহূর্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের ৭১ শতাংশই নির্বাহ করে পরিবার। আর এই অর্থের সবচেয়ে বড় অংশই ব্যয় হয় কোচিংয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আটকে আছে কোচিংয়ে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যয় দুই রকম।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের পড়তে গেলে কোনো বেতন দিতে হয় না। নেই কোনো ভর্তি ফিও। তবে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন ও শহরাঞ্চলের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার জন্যই চড়া মূল্য দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। রাজধানীতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলভেদে শুধু ভর্তি ফি নেওয়া হয় ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও একই চিত্র। রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির টিউশন ফি ১২ টাকা। নবম ও দশম শ্রেণিতে তা ১৫ টাকা। ভর্তি ফি শ্রেণিভেদে এক হাজার থেকে এক হাজার ৪০০ টাকার মধ্যে। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মণিপুর হাইস্কুল ও মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি ফি কমবেশি ২০ হাজার টাকা। টিউশন ফি ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের টিউশন ফি আট হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। প্রতিষ্ঠান ভেদে এ ব্যয় বাড়ে-কমে।

দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যয় নামমাত্র মূল্যে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবার তার বিপরীত চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাসে ২৫ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও একই টিউশন ফি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার জন্য সাবজেক্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে বর্তমানে পাঁচ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে।

দুই সিটির মধ্যে শিক্ষায় বৈষম্য বাড়ায় নানা দুর্ভোগও পোহাতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। এক অঞ্চলের শিক্ষার্থী অন্য অঞ্চলে যাওয়ায় বাড়ছে যানজট। প্রতিদিন সকালে অভিভাবকদের পুরান ঢাকা থেকে শিশুদের নিয়ে দৌড়াতে হচ্ছে নতুন ঢাকায়। আবার ফিরতে হচ্ছে বিকেলে। এক সময় পুরান ঢাকায় ছিল নামকরা স্কুলগুলো। এসব বিদ্যালয়ে রয়েছে প্রশস্ত মাঠ, বড় বড় ক্লাসরুমসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু আগের সুনাম আর নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এসব বিদ্যালয় মেধাতালিকায় আসতে পারেনি। দক্ষিণে অবস্থিত ঢাকা কলেজের সুনামও আগের চেয়ে কমেছে। ঢাকা দক্ষিণে বিশ্ববিদ্যালয় ১১টি; তিনটি সরকারি, আটটি বেসরকারি। বেশির ভাগ নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান উত্তর সিটি করপোরেশনে। ঢাকা উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টি; এসবের মধ্যে সরকারি দুটি, বেসরকারি ৩৮টি।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, লৌহমানব হিসেবে খ্যাত স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ‘শরীফ কমিশন’ নামে খ্যাত তৎকালীন শিক্ষা সচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বে গঠিত ১১ সদস্যের এ কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবেদন পেশ করেন। এতে শিক্ষা বিষয়ে যেসব প্রস্তাবনা ছিল, তা প্রকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষে গিয়েছিল। প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সস্তায় শিক্ষা অর্জন করা যায় বলে যে ভুল ধারণা রয়েছে, তা ত্যাগ করতে হবে। এতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিল। চাপিয়ে দেওয়া তখনকার গণবিরোধী এ শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাজ ফুঁসে উঠেছিল। গড়ে তুলেছিল গণপ্রতিরোধ।

চাপিয়ে দেয়া শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি প্রতিহত করতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন অল পার্টি স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি’ দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা লেলিয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। এর একপর্যায়ে ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মোড়ে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ প্রমুখ শহীদ হন। সরকার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। সেই থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতি বছর এ দিনটিকে মহান শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। দিনটিকে আইয়ুববিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শিক্ষা,বৈষম্য,শিক্ষা দিবস
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist