এ আর রাশেদ, ইবি প্রতিনিধি

  ২০ অক্টোবর, ২০১৮

ইবিতে কেন বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবনতা?

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) দিন দিন বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের ঘটনা। সর্বশেষ শুক্রবার এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহননের মধ্যদিয়ে গত দুই বছরে পাঁচ শিক্ষার্থী চলে গেল না ফেরার দেশে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় আত্মহত্যা বিরোধী সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করা হলেও থামছেনা আত্মহননের ঘটনা। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক অসচেতনতা, মানসিক বিষন্মতা, একাকিত্বতা, নৈতিকতার অভাব ও প্রেমজনিত কারণে দিন দিন এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের সদস্য মনোবিজ্ঞানী ডা. সাইদ এনামের মতে, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন প্রতিবছরের ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘ওয়ার্কিং টুগেদার টু প্রিভেন্ট সুইসাইড’ অর্থাৎ ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি একসঙ্গে’। একজন মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারেন। এর মধ্যে ব্যক্তিত্ব্যের সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতার মানসিক, মাদকাসক্তি, এনজাইটি, ডিপ্রেশন অথবা প্ররোচনা ইত্যাদি।

এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে। ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার নারীদের মধ্যে বেশি। সাধারণত কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।

ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনি বিভাগের নাজমুল হাসান নামের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রাত পৌনে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদ্দাম হোসেন হলের ২২৯নং কক্ষে সে গলায় ফাঁস লাগালে তার বন্ধুরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

নাজমুলের সহপাঠীরা জানায়, নাজমুল হাই প্রেসারের রোগী। বেশ কিছুদিন ধরে সে অসুস্থ্যতার মধ্যে ছিল। প্রতিদিন সে ১২টি করে ট্যাবলেট সেবন করত এবং সবসময় বিষণ্নতা ও হতাশার মধ্যে থাকতো।

এর আগে গত ৯ আগস্ট মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী মুমতাহেনা আফরোজ গলায় ফাঁস দিয়ে এবং তার সহপাঠী রোকনুজ্জামান ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রোকনুজ্জামান ও মুমতাহেনার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। হেনার পরিবার তাকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দেয়। তাদের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারকে জানালে তারা মেনে নিতে রাজি হয়নি।

এছাড়াও তাদের আত্মহত্যার কয়েকদিন আগ থেকে দুজনের মধ্যে মনমালিন্য চলছিল বলে জানা যায়। ফলে ঐ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ঝিনাইদহ শহরের ঝিনুক টাওয়ারের পঞ্চম তলার একটি কক্ষে ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে হেনা। এরপর মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে রাত সাড়ে আটটায় প্রেমিকার আত্মহত্যার খবর শুনে প্রেমিক রোকনুজ্জামান কুষ্টিয়া শহরের মতি মিয়া রেল গেটে ট্রেনের নিচে লাফ দিলে আত্মহত্যা করেন। রোকনুজ্জামান বিবিএ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন। হেনাও প্রথম শ্রেণীতে (সম্মান) শেষ করেন।

চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইমুজ্জামান খান সাইম ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এক মেসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জানা যায়, প্রেমিকার প্রতি অভিমান করে চিরকুট লিখে সে আত্মহত্যার মতো দু:সাহসিক ঘটনা ঘটায়।

এর আগে ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন ও রাষ্ট্রনীতি বিভাগের মাস্টার্সের (স্নাতকোত্তর) শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান আতিক কুষ্টিয়া শহরের কাস্টম মোড় এলাকার এক মেসে ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। জানা যায়, আত্মহত্যার আগে সে তার অসুস্থতার কথা চিরকুটে লিখে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার পথে পাড়ি জমায়।

এদিকে গত কয়েক বছরের ব্যাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়ায় শুক্রবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও অভিমত ব্যাক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, ক্যাম্পাসে শুধুমাত্র সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ অথবা শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক সুসম্পর্ক ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে সচেতন করা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও আল-ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাছির উদ্দিন তার ফেসবুকে পেজে উল্লেখ করেন, ‘আত্মহত্যার মূল কারণ ধর্মীয় জ্ঞান ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। যখন কেউ হতাশ ও নিজেকে খুব অসহায় মনে করে তখন আত্মহত্যার কুচিন্তা মনে আসে। তখন মনে করতে হবে এখন কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানের দুরভিসন্ধি এসেছে। তাই এসব মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। আত্মহত্যার কথা মনে এলে এ থেকে নিজকে রক্ষার জন্য নামাজের মাধ্যমে বিনীতভাবে আল্লাহর সাহায্য ও দয়া কামনা করা উচিত।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহজাহান মন্ডল বলেন, ‘আমাদের দেশে আত্মহত্যা একটি অপরাধ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী, আত্মহত্যায় প্রচারণাকারীকেও কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আত্মহত্যার প্রবনতা কমাতে হলে প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।’ এছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসমুখি হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরো বাড়ানোর মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রবনতা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন উর রশিদ আসকারী বলেন, আত্মহত্যার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন রকমের প্রাতিষ্ঠানিক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি তারা যেন কোনোভাবেই তাদের মূল্যবান প্রাণ নষ্ট না করে। আমাদের যে মেডিকেল পুল রয়েছে সেখানে একজন সাইকিয়াট্রিক নিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। যেটা ছাত্র উপদেষ্টা দেখভাল করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের যেকোনো সমস্যার কথা তাদের কাছে তুলে ধরবেন এবং তারা এ ব্যাপারে পরামর্শ দিবেন। সবচেয়ে বড়কথা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জীবনবোধ এবং জীবনের মূল্য আরো বেশি জাগ্রত করতে হবে তাহলেই আত্মহত্যা প্রবনতা কমানো যাবে।’

পিডিএসও/অপূর্ব

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ইবি,আত্মহত্যা,প্রবনতা,বাড়ছে
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close