রাহাতুল ইসলাম রাফি, ঢাবি

  ২৯ আগস্ট, ২০১৯

আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে

চলতি বছরের মার্চ মাসে আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী সবুজ চন্দ্র মিত্র। ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট সংগীত বিভাগের মুশফিক বাবু এবং ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের হুজাইফা রশিদ আত্মহত্যা করেন। গত ১৫ বছরে আত্মহত্যা করেন ঢাবির অন্তত ২৪ জন শিক্ষার্থী। এ অবস্থা নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার যে আয়োজন রয়েছে তাকে অপ্রতুল বলেছে সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে যে ২৪ জন আত্মহত্যা করেছেন এর মধ্যে ২০০৫ সালে দুজন, ২০০৬ সালে দুজন, ২০০৭ সালে দুজন আত্মহত্যা করেন। এরপর ২০১২, ২০১৪ ও ২০১৬ সালে প্রতি বছর একজন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। ২০১৫ সালে চারজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। এছাড়া ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন তিন ঢাবি শিক্ষার্থী। শুধু ২০১৮ সালেই আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষার্থী। ওই বছরের নভেম্বর মাসেই এদের মধ্যে চারজন আত্মহত্যা করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শিল্পী রানী সরকার। পরের বছর একই কারণে আত্মহত্যা করেন রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাজেদা আক্তার। ২০১৫ সালে প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেন ঢাবি ছাত্র ও সংগীতশিল্পী নাইম ইবনে পিয়াস রেজা।

২০১৪ সালের ২ জুন হতাশার কারণে ট্রেনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাহবুব শাহিন। মৃত্যুর আগে তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘এই হতচ্ছাড়া নিজেকে দূরে সরিয়ে দিতে যাচ্ছি, যে অপদার্থ কি না শুধু খেতেই জানে’।

২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের মুশফিক বাবু আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে সরকার ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে মুশফিক ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন।

চাকরি না পাওয়ার হতাশায় ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থী তারেক আজিজ। এই ধরনের কারণেই ২০১৮ সালের মার্চ মাসে আত্মহত্যা করেন ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সান্ধ্যকালীন এমবিএ’র ছাত্র তানভীর রহমান।

২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হুজাইফা রশিদ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার পেছনে কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসে ‘অ্যাকাডেমিক লাইফ নিয়ে হতাশা’র কথা। ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি একই কারণে আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তরুণ হোসেন। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী সবুজ চন্দ্র মিত্র আত্মহত্যা করেন ‘মিড টার্মে নাম্বার কম পাওয়া’র হতাশায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজের বিভাগ, শিক্ষক ও অ্যাকাডেমিক লাইফ এবং প্রেমসংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বিফল হওয়ার নজিরও আছে। চলতি বছরের জুলাই মাসে নিজ বিভাগের শিক্ষক দ্বারা অপমানিত হওয়ায় হাতের রগ কেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আরমান শাহরিয়ার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

গত বছর নভেম্বর মাসে আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে উল্লেখ করে প্রক্টর বরাবর চিঠি প্রেরণ করেন ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী। কারণ হিসেবে চিঠিতে তিনি ‘পরীক্ষায় বসার জন্য প্রশাসন কর্তৃক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা’ দিতে অপারগতার কথা উল্লেখ করেন।

১৫ অক্টোবর ২০১৮ পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির হোসেন নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

এভাবে গত ১৫ বছরে ঢাবি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনের কারণ হিসেবে শিক্ষাজীবন শেষে চাকরিসংকট, বেকারত্ব, প্রেমঘটিত সমস্যা, অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিগত ও পারিবারিকসহ বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত হতাশার কথা উঠে আসে।

শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দফতর। তবে সেখানে ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য রয়েছে মাত্র একটি পার্মান্যান্ট কোর্স। যাতে জীববিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ও এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা ৩০ জন শিক্ষার্থী অস্থায়ীভাবে সার্ভিস দিয়ে থাকেন। এছাড়া পুরো দফতরে কাউন্সিলর আছেন মাত্র একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য যা অপ্রতুল বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক মেহ্জাবিন হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে শিক্ষার্থীরা আসেন। এর মধ্যে প্রেমঘটিত সমস্যাই বেশি। এর বাইরে অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রবলেম, বন্ধুত্ব, সামাজিক দক্ষতা, পারিবারিক সমস্যাসহ আরো অনেক কারণ পাওয়া যায়।’

শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী তার দায়িত্বাধীন দফতরে কাউন্সিলর ও কোর্সের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের যা আছে, তা দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যায়। তবে আরো কয়েকটি কোর্স বাড়ানোর একটি বিষয় প্রক্রিয়াধীন আছে। প্রশাসনকেও এরই মধ্যে এই ব্যাপারে অবহিত করেছি।’

এই ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি প্রশাসন কোনোভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে এই ব্যাপারে আমি কথা বলব।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আত্মহত্যার চেষ্টা,আত্মহত্যা প্রবণতা,ঢাবি শিক্ষার্থী,শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা,আত্মহত্যা
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close