শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ২৯ মার্চ, ২০১৮

বিদেশি চক্রের কবলে চট্টগ্রাম বন্দর

দস্যুতার নেপথ্যে মিলছে অন্যকিছু

বাংলাদেশের জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজে ‘চুরি-ডাকাতি’ বা দস্যুতা বেড়ে গেছে। গত বছরে বাণিজ্যিক জাহাজে এই দস্যুতার ঘটনা ঘটে ১১টি। আর এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ঘটে একটি। এই সংখ্যা বাড়ার পেছনে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চক্রান্ত করার অভিযোগ উঠেছে। তবে এসব ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ আছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর অনেক নাবিক বন্দরের বদনাম করার জন্য জলসীমায় আসার পরপরই মিথ্যা ‘পাইরেসি কল’ (দস্যুতার সংকেত) পাঠিয়ে দিচ্ছে দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর কাছে। এছাড়া এই বন্দরকে ‘পাইরেসি বন্দর’ হিসেবে চিহ্নিত করতে আন্তর্জাতিক কয়েকটি ইন্স্যুরেন্স (বীমা) কোম্পানিও কাজ করছে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাবিকরাই নিজেদের জাহাজের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে দিয়ে ডাকাতির অভিযোগ বলে চালিয়ে আসছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দর ও ভারতের বন্দরগুলোর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের অঘোষিত প্রতিযোগিতা আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জলসীমায় দস্যুতার ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া দস্যুতার সংখ্যা বাড়ার পেছনে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিরও চক্রান্ত রয়েছে।

প্রতিটি বাণিজ্যিক জাহাজে যে পণ্য পরিবহন করা হয়, তার ইন্স্যুরেন্স করতে হয়। এক্ষেত্রে জলদস্যুপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত দেশগুলোতে জাহাজ পাঠানোর ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স করতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। বর্তমানে দেশের জলসীমা আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত নয়। ফলে জাহাজগুলোর কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা আদায়ের সুযোগ পাচ্ছে না ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এ পরিপ্রেক্ষিতে মিথ্যা দস্যুতার সংকেত পাঠিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য জাহাজে কর্মরতদের নানাভাবে প্রভাবিত করে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো। যাতে জাহাজ চলাচলের জন্য ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে চিহ্নিত করা যায়।

এ প্রসঙ্গে কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম ওয়াসিম মকসুদ বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি মিথ্যা দস্যুতার সংকেত দেয় ভারতীয় ও চীনের নাবিকরা। অথচ ইউরোপ-আমেরিকার নাবিকদের কাছ থেকে দস্যুতার সংকেত পাওয়া যায় না বললেই চলে, তারা পেশার প্রতি খুবই সৎ। এছাড়া দস্যুতার ঘটনা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ‘হিডেন গেম’ থাকে। এ রকম বেশকিছু প্রমাণ পেয়েছি। এমনকি ধরা পড়ে সেসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোকে জরিমানাও দিতে হয়েছে বিভিন্ন সময়।’

অভিযোগ আছে, কথিত দস্যুতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন জাহাজের নাবিকরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। তারাই জাহাজের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে দিয়ে চুরির অভিযোগের পাশাপাশি অহেতুক মিথ্যা দস্যুতার সংকেত পাঠিয়ে দিচ্ছে দস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইএমবি ও রিক্যাপের কাছে। মিথ্যা দস্যুতার সংকেত পাঠিয়ে কয়েক ধরনের লাভ হয় জাহাজে কর্মরতদের।

প্রথমত, চুরির ঘটনা দেখিয়ে নিজেরাই জাহাজের পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার সুযোগ পায়। আবার একই ঘটনা দেখিয়ে জাহাজের পণ্য বিনিময় করে ট্রলার নিয়ে গভীর সাগরে যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকে সবজি-মুরগী-ছাগল ইত্যাদি নেয় তারা। বিগত সময়ে কিছু ঘটনা জাহাজ পরিচালনাকারী ও চুরির সঙ্গে জড়িতদের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সংঘটিত হয়েছে বলেও কোস্টগার্ডের তদন্তে ওঠে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম ওয়াসিম মকসুদ বলেন, ‘সবজিসহ নিত্যপণ্য বহন করা বাংলাদেশি ট্রলারগুলো যাতে বহির্নোঙরে যেতে না পারে সে জন্য তৎপরতা শুরু করেছে কোস্টগার্ড।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বহির্নোঙরে সংঘটিত চুরি-ডাকাতির ঘটনা বাড়লে বিদেশি জাহাজের দেশে চলাচলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্য পরিবহনে বাড়তি জাহাজ ভাড়া আরোপ করা হয়। তাতে বিপাকে পড়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন দেশীয় আমদানি-রফতানিকারকরা। এছাড়া দস্যুতার ঘটনা বৃদ্ধির ফলে বহির্বিশ্বে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে।

জলদস্যু ওয়াচডগ রিক্যাপের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জলসীমায় ২০১২ সালে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১১টি, ২০১৩ সালে ছয়টি, ২০১৪ সালে ১৬টি ও ২০১৫ সালে ১০টি। এরপর কোস্টগার্ডের নানা তৎপরতার ফলে ২০১৬ সালে ঘটেছে মাত্র একটি। ২০১৭ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ১১টি। ২০১৭ সালের ১১টি দস্যুতার ঘটনার মধ্যে চারটি ঘটেছে বন্দরের জলসীমা। বাকি ঘটনাগুলো ঘটেছে কক্সবাজারের মহেশখালী ও কুতুবদিয়া এলাকার গভীর সাগরে। অন্যদিকে, ২০১৬ সালে বিশ্বে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ৮৫টি, যা ২০১৭ সালে বেড়ে ১০১টি হয়েছে। ২০১৭ সালে চারটি দেশে দস্যুতার ঘটনা বেড়েছে, সেগুলো হলো বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, দক্ষিণ চীন সাগর ও সিঙ্গাপুর।

এদিকে, চলতি বছরের গত ৩১ জানুয়ারি ভোর ৫টার দিকে বহির্নোঙরের কুতুবদিয়া অংশে চীনের পতাকাবাহী পোর্ট হাইনান নামের একটি জাহাজে দস্যুতার ঘটনা ঘটে। ৬ ফেব্রুয়ারি রাত আড়াইটার দিকে বন্দরের বহির্নোঙরে বিবিসি অ্যাম্বার নামের অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডার পতাকাবাহী একটি জাহাজে দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাত দেড়টার দিকে বহির্নোঙরে টিবিরিয়াস নামে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের একটি জাহাজে দড়ি চুরির ঘটনা ঘটে।

মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কোস্টগার্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে থাকা একটি জাহাজ থেকে অভিযোগ আসে তাদের জাহাজের একটি অংশ কেটে নিয়ে গেছে দস্যুরা। এরপর অভিযোগ তদন্তে আমরা সেখানে যাচ্ছি জানার পর জাহাজটি বহির্নোঙর ছেড়ে মোংলার দিকে চলে যায়। পরে মোংলায় কর্মরত কোস্টগার্ডের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তখন তারা ওই জাহাজে গিয়ে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু জাহাজটিতে থাকা ব্যক্তিরা অভিযোগ করার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে কোনো ঘটনাই ঘটেনি বলে জানায়।’

মিথ্যা দস্যুতার সংকেত পাঠানো জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না প্রশ্নে কোস্টগার্ডে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনাকারীদের নানা সংগঠন আছে। তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে গেলে তারা আবার বিবৃতি দিয়ে বলবে যে, বাংলাদেশের কোস্টগার্ড হয়রানি করে! এছাড়া দস্যুতার ঘটনা পর্যবেক্ষণকারী আইএমবি এবং রিক্যাপ লাভজনক সংস্থা। তারা দস্যুতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এর পেছনেও নানা স্বার্থ থাকে। এসব কারণে মিথ্যা অভিযোগ করা সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোর বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ ও কঠোর ব্যবস্থার দিকে আমরা যেতে পারি না।’

একই প্রসঙ্গে কোস্টগার্ড পূর্ব জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন এম ওয়াসিম মকসুদ বলেন, ‘দস্যুতার যেসব ঘটনা দেখানো হয়, এর বেশিরভাগই মিথ্যা। এই ধরনের বেশ কয়েকটা ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। পরে তথ্য-প্রমাণসহ আইএমবি, রিক্যাপসহ সংশ্লিষ্টদেরকে আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছে সেসব।’

এদিকে, প্রায় ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে ভিটিএমআইএস (ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম) নামের প্রকল্প চালু করে। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বন্দরের জলসীমায় দস্যুতা ও দুর্ঘটনা রোধ করে নিরাপদ জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা করা। প্রকল্পটি চালুর পর সরাসরি বন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে জাহাজ চলাচল তদারকির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখন বন্দরের জলসীমায় পণ্যবাহী জাহাজের আশপাশে থাকা কোনো নৌযানকে সন্দেহজনক হিসেবে শনাক্ত করা হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে বন্দর। এরপরও জাহাজে চুরি-ডাকাতি বা দুর্ঘটনা না কমায় প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম বলেন, ‘সন্দেহভাজন কোনো নৌযান জাহাজের কাছাকাছি গেলে মাস্টারদের উচিত তাৎক্ষণিক বিষয়টি বন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষকে জানানো। অনেক সময় মাস্টাররা বন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষকে তা ৩-৪ ঘণ্টা বিলম্বে জানান। আবার বিদেশি নাবিকরা জাহাজের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে দিয়ে ডাকাতির অভিযোগও করে। ফলে অনেক দস্যুতার অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায় না।’

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিদেশি চক্র,চট্টগ্রাম বন্দর,দস্যুতা,বাণিজ্যিক জাহাজ,কোস্টগার্ড
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist