আব্দুস সালাম

  ২০ জুলাই, ২০১৯

হরিৎসংঘ

নাদের, আনজুম, হাসিন ও ইশরাক এরা চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা সকলে একই ক্লাসে পড়ে। একই সঙ্গে এরা চলাফেরা করে। নাদের বয়সে একটু বড় হওয়ায় অন্য বন্ধুরা তার কথায় একটু বেশি গুরুত্ব দেয়। হেমনগর গ্রামের দক্ষিতুপাড়ায় তাদের বসবাস। ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, হাডুডু ও ডাংগুলির মতো যেকোনো ধরনের খেলাধুলা বা পাড়াঘরে কোনো অনুষ্ঠান হলে তাদেরকে একসঙ্গে দেখা যায়। এ কারণে গ্রামবাসীরা তাদেরকে একনামে চেনে।

কয়েক দিন আগে আবিদ স্যার তাদের একটা ক্লাসে গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ‘বৃক্ষুরোপণ’ বিষয়ে ক্লাস নিয়েছেন। চার বন্ধু মনোযোগ দিয়ে স্যারের ক্লাসটি করেছে। স্যার বলেন, তোমরা অনেকেই জান যে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষুার্থে একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে বনাঞ্চল রয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। বৃক্ষু আমাদের পরমবন্ধু। আমাদের আশপাশে যদি গাছপালা না থাকত, তা হলে আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারতাম না। বৃক্ষু ও মানুষ একে অপরের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৃক্ষু আমাদের নানাভাবে উপকার করে। গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। আর সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে আমরা বেঁচে থাকি। তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় আমরা যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি তা গ্রহণ করে গাছপালা বেঁচে থাকে। একটি গাছ বছরে প্রায় ১৩ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষুায় বৃক্ষু অপরিহার্য। বৃক্ষু প্রাণিকুলের খাদ্য সরবরাহ করে, বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে, মাটির ক্ষুয়রোধ করে, কাঠ দেয়, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, অতি বেগুনি রশ্মির হাত থেকে পরিবেশকে রক্ষুা করে, পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। বৃক্ষেুর নির্মল বাতাস আমাদের দেহমনে শিহরণ জাগায়। বৃক্ষেুর বিশুদ্ধ ও হিমেল বাতাস আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে বৃক্ষেুর ছায়া আমাদের দেহমনে প্রশান্তি ও স্বস্তি আনে। তাই ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের প্রাকৃতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অথচ আমরা অবাধে কারণে-অকারণে বৃক্ষু নিধন করে চলেছি। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিœত হচ্ছে। মানবজীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আমাদের উচিত বেশি বেশি গাছ লাগানো। আর একটা কথা মনে রাখবা, বৃক্ষুরোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। স্যার আরো বলেন, বৃক্ষু আল্লাহপাকের গুণগান করে। তারা সর্বদা ধ্যানে মত্ত থাকে। আমাদের প্রিয় নবী রাসুল (সা.) নিজ হাতে বৃক্ষুরোপণ ও পরিচর্যা করেছেন। নবীজী (সা.) বৃক্ষুরোপণ করতে তার উম্মতকে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) কৃষিকাজ ও বৃক্ষুরোপণে উৎসাহিত করেছেন। যাতে উদ্ভিদ বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ পরিবেশ অক্ষতুœ থাকে। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) অপ্রয়োজনে বৃক্ষু নিধন করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করেছেন।

আবিদ স্যারের বৃক্ষুরোপণের ক্লাসটি নাদেরের মনে দাগ কাটে। এক দিন চার বন্ধু একত্রে বসে বৃক্ষুরোপণের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করে। নাদের বলে, “আমরা গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে গ্রামবাসীদের অবহিত করতে চাই। গ্রামবাসী যেন অকারণে বৃক্ষু নিধন না করে এবং বেশি বেশি গ্রাছ লাগায়। আমরা এই কাজটি একটি সংঘের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে করতে পারি। আমরা সংঘের নাম দেব ‘হরিৎসংঘ’। এই সংঘ বৃক্ষুরোপণ নিয়ে কাজ করবে। সবার জন্য ‘হরিৎসংঘ’-এর সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত থাকবে। আমরা হরিৎসংঘের উদ্যোগে গ্রামে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলব। যেখানে বৃক্ষু নিয়ে গবেষণা করা হবে। গ্রামের বৃক্ষু সম্পর্কে একটি ডেটাবেইজ থাকবে। পত্রপত্রিকায় বৃক্ষু নিয়ে কোনো ফিচার ছাপা হলে আমরা তা সংগ্রহ করব। আমরা গ্রামের সকল পতিত জমিতে বৃক্ষুরোপণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” নাদেরের প্রস্তাব অন্য তিন বন্ধু একবাক্যে সমর্থন করে। তারা এটাকে উত্তম প্রস্তাব বলে মনে করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামীকাল থেকেই ‘হরিৎসংঘ’ নিয়ে কাজ শুরু করবে। পরদিন নাদের বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের মেম্বার আক্কাস সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাদের পরিকল্পনার কথা খুলে বলে। সে এও বলে যে, এ বিষযে আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন। মেম্বার সাহেব পরিকল্পনার কথা শুনে যারপরনাই খুশি হয়। সে নাদেরকে বলে, ‘এখন বলো আমি তোমাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’ নাদের বলে, গ্রামের কোনো স্থানে একটা ঘর দরকার যেখান থেকে হরিৎসংঘের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার যাবে। মেম্বার সাহেব তাদের প্রস্তাব মেনে নেয়। কিছুদিন পর গ্রামের মেম্বার সাহেব হরিৎসংঘের জন্য সুন্দর দুটি ঘরই দেয়। ঘরের জন্য চেয়ার-টেবিল, আলমিরাসহ যা যা দরকার তার সবকিছুই ব্যবস্থা করে দেয়। ঘরের বাইরে একটি সাইনবোর্ডে লিখে রাখে ‘হেমনগর হরিৎসংঘ’।

মাসখানিকের মধ্যে গ্রামের অর্ধশত যুবক হরিৎসংঘের সদস্য হয়। তারা একযোগে কাজ শুরু করে। হেমনগরের দুই পাশে যত পতিত জমি ছিল তারা সেসব স্থানে ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে। রাস্তার দুই পাশে অসংখ্য খেজুরগাছ রোপণ করে। গ্রামের সবাই চারা ক্রয়ের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। গাছগুলো যেন গরু-ছাগল খেতে না পারে বা কেউ অকারণে নিধন করতে না পারে, তার জন্য তারা নানা রকম পদক্ষেুপ গ্রহণ করে। গাছের পরিচর্যা করার জন্য আনজুম, হাসিন ও ইশরাককে প্রধান করে একাধিক কমিটি গঠন করা হয় এবং তাদেরকে বিভিন্ন এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সকলে মনের আনন্দে কাজ করে। ওদিকে বর্ষার পানি পেয়ে গাছগুলো তর তর করে বেড়ে ওঠে। খেজুরগাছগুলো যতœ নেওয়ার জন্য সদস্যদের তেমন কিছু করতে হয় না। গাছের পাতার অগ্রভাগের সূচালো কাঁটা থাকার কারণে গরু-ছাগল খেতে পারে না। তাছাড়া বৃষ্টি ও খরায় গাছগুলো সহজে বাঁচতে পারে।

বছর পাঁচেকের মধ্যে অনেকগুলো গাছে ফল ধরা শুরু করে। বলা যায়, প্রতিটি ঋতুতেই কোনো না কোনো গাছে ফল ধরে। ফলগুলো যথা নিয়মে সংগ্রহ করা হয়। আক্কাস মেম্বারের সহযোগিতায় হরিৎসংঘের সদস্যরা সেগুলো গ্রামের প্রতিটি পরিবারে বণ্টন করে দেয়। গ্রামের যেসব ছেলে উচ্চশিক্ষুার জন্য শহরে থাকেন, তারা বৃক্ষুসংক্রান্ত বই-পুস্তক হরিৎসংঘের লাইব্রেরিতে দান করে। গ্রামবাসীরা অবসর সময়ে সেসব বই-পুস্তক পড়ে থাকেন। তারা দিনে দিনে অনেক কিছু জানতে পারেন। হরিৎসংঘের সফলতার কথা আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অন্য গ্রামগুলো? হেমনগরকে অনুসরণ করে। তারাও নিজ নিজ গ্রামে হরিৎসংঘ গড়ে তোলে। নাদের, আনজুম, হাসিন ও ইশরাক এখন গ্রামের গর্ব। সকলে তাদের উদ্যোগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এভাবে সত্যি সত্যিই এক দিন দেখা যায়, হেমনগরসহ আশপাশের গ্রামগুলো সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা গ্রামে পরিণত হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close