আবদুস সালাম

  ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বনের রাজা

সে অনেক দিন আগের কথা। একটি দেশের শেষপ্রান্তে হরিৎকানন নামে বড় একটি বন ছিল। ওই বনটির ঠিক মাঝ বরাবর একটি নদীও ছিল। সেই বনে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি বাস করত। এক দিন একটি বয়স্ক বাঘ সারা দিন শিকার ধরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার জন্য সে একটা জায়গা খুঁজছিল। এমন সময় বড় একটি গাছ তার নজরে পড়ল। গাছটির উদ্দেশে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। বাঘটি যখন গাছটির নিচে এসে পৌঁছাল তখন গাছের শীতল ছায়ায় তার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। তার পেটটি ভরা ছিল বলেই কিছুক্ষণের মধ্যে চোখে তন্দ্রাভাব এসে গেল। একটু পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। বাঘটি যখন ঘুমাচ্ছিল ঠিক তার মাথা বরাবর শুকনা একটা ডালে বসে একটি বানর গাছের ফল খাচ্ছিল। হঠাৎ ডালটি ভেঙে বানরটি ঘুমন্ত বাঘের ওপর পড়ে গেল। বাঘটি জেগেই বানরটিকে খপ করে ধরে ফেলল। তার তখন প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বানরটি ভয়ে কাঁপতে থাকে। সে অপরাধ স্বীকার করে বাঘের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল। সে অনুনয় বিনয় করে বলল, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে মাফ করে দাও। দয়া করে আমাকে হত্যা করবে না। তুমি যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখ, তাহলে আমি তোমাকে অনেক উপকার করব।

: বল তুই আমার জন্য কী উপকার করবি?

: আমি গাছের মগডালে বসে সবকিছু দেখতে পাই। তোমাকে শিকার ধরার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না। কোথায় কোনো শিকার আছে, তা দেখামাত্র তোমাকে বলে দেব।

বাঘের পেটটা তখন ভরা ছিল। সে ভাবল সুযোগ নেওয়া যেতে পারে। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, তা বেশ। তোকে ছেড়ে দিলাম। এখন দেখি তুই আমার জন্য কী করিস। তবে মনে রাখিস, আমাকে যদি কোনো উপকার করতে না করিস তাহলে কিন্তু তুই আর বাঁচতে পারবি না।

বানরটি প্রাণে রক্ষা পাওয়ায় সে বাঘের প্রতি বেশ কৃতজ্ঞ হলো। সে বাঘের কাছে যে ওয়াদা করেছিল তা ঠিক ঠিকভাবে পালন করার জন্য চেষ্টা করতে থাকল। সে নিয়মিত বাঘকে শিকার ধরার কাজে সাহায্য করত। বাঘকে আর শিকার ধরার জন্য তেমন কষ্ট করতে হতো না। সে অতি সহজেই শিকার করতে পারত। বাঘটি এক দিন মনে মনে ভাবল, আমার তো এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। একটু দৌড়াদৌড়ি করলেই হাঁপিয়ে উঠি। আমার পক্ষে তো আর বেশি দিন শিকার করা সম্ভব নয়। আমি যদি বনের রাজা হতে পারতাম তাহলে খুব সহজেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। তাহলে আমাকে আর কষ্ট করে শিকার করতে হতো না। বিষয়টি নিয়ে বানরের সঙ্গে আলাপ করা দরকার। ঠিক দুই দিন পর বাঘটি তার ইচ্ছার কথা বানরের কাছে প্রকাশ করল। সব কথা শুনে বানর বলল, উত্তম প্রস্তাব। আপনার ইচ্ছা যেন পূরণ হয়, সেজন্য আমি আপনাকে সবদিক দিয়ে সাহায্য করব। কীভাবে রাজা হওয়া যায়, সে বিষয়টি নিয়ে বাঘটি বানরের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত

গ্রহণ করল।

হরিৎকাননের রাজা নির্বাচনের জন্য বানরটি কয়েকজন পশুপাখির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি সভা করার সিদ্ধান্ত নিল। তারপর তারা সভার একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য করল। আর এ সভায় সব পশুপাখিকে উপস্থিত থাকার জন্য তারা আমন্ত্রণ জানাল। তারা সাধ্যমতো সব পশুপাখির সঙ্গে দেখা করে বনের রাজা নির্বাচনের দিনক্ষণ জানিয়ে দিল। এ খরব শুনে পশুপাখিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। তারা খুব মজা করে বনের রাজা নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে থাকল। তখন সকলের মুখে একই কথা কে হবে হরিৎকাননের রাজা? কাকে রাজা বানালে তাদের উপকার হবে। কাকে রাজা বানানো ঠিক হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বাচনের দিনটি খুব মজার ও উৎসবমুখর হবে বলে সব পশুপাখি সেই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল।

দেখতে দেখতে নির্বাচনের দিনটি চলে এল। বনের সব পশুপাখি নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হলো। সভাতে বাঘ, ভাল্লুক, বানর, ঘোড়া, জেব্রা, কুমির, হাতি, হরিণ, খরগোশ, শিয়াল, গাধা, গন্ডার, টিয়া, ময়না, বাদুর, কাক, সাপসহ অনেকেই উপস্থিত হলো। সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য বাঘ বানরের নাম প্রস্তাব করল। সব পশুপাখি তা সমর্থন করল। বানর সবার অনুমতি নিয়ে সভা শুরু করল। সে সকলের উদ্দেশে বলল, ‘আপনারা সকলেই জানেন যে চিরহরিৎ বনটি বেশ বড়। এই বনে অনেক পশুপাখির বসবাস। অথচ দুঃখের বিষয় আমাদের বনে কোনো রাজা নেই। আমরা কোনো সমস্যায় পড়লে কারোর কাছে সাহায্য চাইতে পারি না। কেউ অন্যায় করলেও কারোর কাছে বিচার চাইতে পারি না। এজন্য আমাদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। হরিৎকানন বনে একজন রাজা থাকা খুবই প্রয়োজন। আজকের দিনটি যেমন আনন্দের, তেমনি স্মরণীও বটে। কারণ আজ আমরা একত্রিত হয়েছি আমাদের রাজা নির্বাচন করার জন্য। নির্বাচনে যিনি রাজা হবেন তাকে আমরা বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেব। তার কোনো খাওয়া-দাওয়ার কথা ভাবতে হবে না। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আমরা করে দেব। তিনি শুধু শাসন কাজ পরিচালনা করবেন। আমাদের মঙ্গলের কথা ভাববেন। আপনারা কি আমার সঙ্গে একমত? সকলেই সমস্বরে বলে উঠল হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা সকলেই একমত। আপনি রাজা নির্বাচনের কাজ শুরু করেন।’

এরপর বানর রাজা নির্বাচনের জন্য সকলের মতামত গ্রহণ করল। বানর একে একে সবকে জিজ্ঞাসা করল কে হরিৎকানন বনের রাজা হওয়ার উপযুক্ত? আপনি কাকে রাজা হিসেবে দেখতে চান। এই প্রশ্নের উত্তরে পশুপাখিরা তাদের মতামত প্রদান করতে থাকে। কিন্তু কয়েকজনের মতামত নিয়ে বানর খুব বিপাকে পড়ে যায়। তারা নিজেরাই রাজা হওয়ার জন্য যুক্তি উপস্থাপন করতে থাকে। এর মধ্যে হাতি বলে, আমার মতো বড় কোনো প্রাণী এই বনের মধ্যে একটিও নেই। আমার গায়ে অনেক জোর। আমি শক্তিশালী প্রাণী। একমাত্র আমিই উপযুক্ত হরিৎকানন বনের রাজা হওয়ার। বানর দ্বিমত পোষণ করে বলল, না না। তা হবে কেন? তোমার শূঁড় দেখতে খুব বিশ্রি। তা ছাড়া তোমার রয়েছে মুলার মতো দুটি দাঁত, কুলার মতো বড় বড় কান। তোমাকে কোনোভাবেই রাজা মানাবে না। তোমার রাজা হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। এরপর বানর কুমিরের কাছে মতামত জানতে চাইল। কুমির বলল, আমি নদীতে বসবাস করি। এই নদীতে আমার মতো আর কোনো বড় প্রাণী নেই। পানির মধ্যে অনেক জলজপ্রাণীর বাস। তাদের কারোর কোনো সমস্যা হলে আমি খুব সহজেই তার সমাধান করতে পারব। তাছাড়া আমিই একমাত্র প্রাণী যে জলে ও স্থলে সমানভাবে বিচরণ করতে পারি। অতএব আমিই উপযুক্ত হরিৎকানন বনের রাজা হওয়ার। কুমিরের প্রস্তাবে নদীর সব মাছ, ব্যাঙ এমনকি সাপও সমর্থন করল। কিন্তু বানর দ্বিমত পোষণ করে বলল, না না। তা হবে কেন? আমরা তো কেউ জলে বাস করি না। আমরা কেন তোমাকে বনের রাজা বানাব। আমরা তো কেউ সাঁতার জানি না। কোনো সমস্যায় পড়লে তোমার কাছে যাব কীভাবে? তোমাকে আমরা রাজা বানানো আমাদের কোনোভাবেই উচিত হবে না। এরপর বানর গেল পাখিদের কাছে। পাখিরা বলল, আমাদের মধ্য থেকেই একজনকে রাজা বানানো উচিত হবে। কারণ পাখিরাই একমাত্র প্রাণী যারা আকাশে উড়তে পারে। তাছাড়া আমরা ওপর থেকে সবকিছু দেখতে পারি। কেউ কোনো ক্ষতি করতে এলে আমরা সহজেই তাকে ধরে ফেলতে পারব। আমরা খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত চলাচল করতে পারি। পাখিদের মতামত শুনে বানর বলল, পাখি খুব ছোট প্রাণী। তারা খুবই দুর্বল। তারা কোনোভাবেই রাজা হতে পারবে না। তাদের কোনো ক্ষমতা নেই কাউকে সাহায্য করা। তাই পাখিদের মধ্য থেকে কাউকে রাজা বানানো যাবে না। এভাবে একে একে সকলের যুক্তিকে বানর নাকচ করে দিল।

সবশেষে বানর গেল বাঘের কাছে। বাঘ বলল, আমি যেমন শক্তিশালী তেমনি সাহসী। আমাকে বনের সব প্রাণী ভয় পায়। রাজা হতে হলে শক্তি ও সাহস দুটোই প্রয়োজন। তাছাড়া শাসন কাজ পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আমার রয়েছে। একমাত্র আমিই হরিৎকানন বনের রাজা হওয়ার উপযুক্ত। বাঘের মতামত শুনে বানর বলল, আমার মনে হয় বাঘ ঠিকই বলেছে। একমাত্র বাঘই বনের রাজা হওয়ার উপযুক্ত। আশা করি, আমার সঙ্গে অধিকাংশ পশুপাখিই একমত পোষণ করবে। ওদিকে বানরের প্রস্তাব শুনে বাঘও মনে মনে বেশ খুশি হলো। কিন্তু বানরের প্রস্তাবে সব পশুপাখি একযোগ বলে উঠল না না। আমরা হরিৎকানন বনের রাজা হিসেবে বাঘকে মানি না। তারা বলল, বাঘ আমাদের জন্য কখনো নিরাপদ নয়। সে মাংসাশী প্রাণী। সে সুযোগ পেলেই আমাদের হত্যা করবে। সে ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী। আমরা তাকে কোনোভাবেই রাজা হিসেবে মানব না। বাঘ এসব কথাবার্তা শুনে ওদের প্রতি ভীষণভাবে রেগে গেল। সে চিৎকার করে বলল, ‘অবশ্যই বানর ঠিক বলেছে। কেউ মানুক আর না মানুক এতে আমার কিছুই এসে যায় না। এখন থেকে আমিই হরিৎকাননের রাজা।’ পশুপাখিরা না না বলে প্রতিবাদ করলে বাঘের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। সে চুপ করে থাকতে পারল না। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে সে হুংকার দিয়ে সব পশুপাখির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো ছোটাছুটি

করতে থাকে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close