বিশেষ প্রতিবেদক, রাজশাহী

  ০৭ জুলাই, ২০২০

‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’

চলে গেলেন এন্ড্রু কিশোর

‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটি গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর; গেয়েছিলেন ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো কি মাটি এ চোখ দুটি মাটি খেও না’। এ গানগুলো শুনে চোখে পানি আসেনি এমন মানুষ নেই। গানগুলো একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। গানের মরমি বার্তা মানুষকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে। এখন আবার কাঁদাল, শোকের সাগরে ভাসাল সবাইকে। গতকাল সোমবার ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহীর মহিষাবাতান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে শেষ হলো তার জীবনের গল্প। দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছিলেন আটবারের চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বরেণ্য শিল্পী। তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। এন্ড্রু কিশোর ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’ গত ১১ জুন বিকালে সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তারা। ফিরে আসেন রাজশাহীতে। এখানেই চিরবিদায় নিলেন তিনি। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন মায়ের পাশেই যেন সমাহিত করা হয়।

রাজশাহীতে বোনের বাড়িতে তার দেখভাল করছিলেন বোনজামাই চিকিৎসক প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস ও শফিকুল আলম বাবু। এদিকে, দেশের গানের কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে সংগীতাঙ্গন তথা দেশের শোবিজে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে দেখতে চাইছেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সবাইকে সচেতন থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে এন্ড্রু কিশোরের পরিবার।

কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি শোকবার্তায় এন্ড্রু কিশোরের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় বলেছেন, এন্ড্রু কিশোর তার গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি এই শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শোকবার্তায় মন্ত্রী শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শোক জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি শিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

শোক জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শোবিজরা। বাংলা গানের এই কণ্ঠশিল্পী ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্র জগতের কালজয়ী অনেক গান তার কণ্ঠে সমৃদ্ধ হয়েছে। সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ সব অনুভূতির গানই তিনি গেয়েছেন।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর তিনি রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে সংগীতের পাঠ শুরু করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর কিশোর নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক, দেশাত্মবোধকসহ প্রায় সব ধারার গানে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত হন। চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। ছবির নাম ‘মেইল ট্রেন’। পরিচালক শিবলী সাদিক। এই ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তার প্রথম গান। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তার এই গান ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।

দীর্ঘদিন পুরোদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। এন্ড্রু কিশোরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সঙ্গে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘এইখানে দুজনে নির্জনে’সহ অনেক গান। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রের এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ইত্যাদিতে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার ইত্যাদিতে এসেছেন।

এন্ড্রু কিশোরের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক্স ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রসঙ্গত, জনপ্রিয় এই শিল্পী বেঁচে ওঠার আশা করতে পারছিলেন না জানিয়ে তার স্ত্রী লিপিকা ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে কিছু না, পুরোনো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।’

লিপিকা লিখেছেন, ‘ক্যানসারের শেষ ধাপে খুব যন্ত্রণাদায়ক। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।’ তিনি লিখেছেন, ‘এটাই শেষ পোস্ট, এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকব, মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যতœ নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন আর এন্ড্রু কিশোরের এর প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন ও প্রাণ খুলে দোয়া করবেন।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close