দিলীপ কুমার আগরওয়ালা
বিশ্লেষণ
শ্রেণিকক্ষে মুঠোফোন
স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মোবাইল বা মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এক অফিস আদেশে। এতে বলা হয়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মুঠোফোন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ এবং ফোনে কথা বলায় শ্রেণিকক্ষের শিখন-শেখানো কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার কার্যক্রমে মনোযোগী হতে পারছে না। এ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত প্রবণতা রোধে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেরিতে হলেও শ্রেণিকক্ষে মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি প্রশংসার দাবিদার।
দেশে ১৮ বছরের কম বয়সীদের মুঠোফোন ব্যবহারের নিয়ম নেই। অথচ বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করেই উৎসাহী কিছু শিশু-কিশোর ব্যবহার করছে আধুনিক প্রযুক্তির সব মোবাইল হ্যান্ডসেট। স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিশুদের হাতে হাতে এখন মোবাইল সেট। তবে এসব মোবাইলের মাধ্যমে শিশুরা যে শুধু তার পরিবারের সদস্য, শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে তা নয়, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে তারা পর্নো ছবির প্রতিও আসক্ত হয়ে পড়ছে। মুঠোফোনের মাধ্যমে অল্প বয়সী শিক্ষার্থীরা নিজেদের তোলা আপত্তিকর ছবি ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিস্ময়কর সত্য যে, শিশু শিক্ষার্থীদের মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনে দেওয়ার আবদার পূরণ করছেন খোদ অভিভাবকরাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি প্রযুক্তি নিয়ে শিশু-কিশোরদের অতি আগ্রহ, মুঠোফোনের সহজলভ্যতা ও স্বল্প দামের কারণে শিশুদের মধ্যে মুঠোফোন নিয়ে ‘কৃত্রিম চাহিদা’ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু শিশুদের দ্বারা মুঠোফোনের অপব্যবহার হচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। ১৮ বছরের কম বয়সীরা পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে রেজিস্ট্রেশন না করেই অবৈধভাবে সিম ক্রয় করে আইনের লঙ্ঘনও করছে। এর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। শ্রেণিকক্ষে বা কোচিংয়ে পড়তে গিয়ে মুঠোফোনে সংযুক্ত ক্যামেরা দিয়ে স্কুল-কলেজের ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলছে সহপাঠী মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি। পরে ছবিগুলো অপব্যবহার করে আপত্তিজনকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীদের মোবাইল সেট ও ইন্টারনেটে। মেয়ে শিশু ও কিশোরীদের অবস্থাও নাজুক। হঠাৎ মুঠোফোন হাতে পেয়ে কৌতূহলবশত অবুঝ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের কথোপকথনে অপরিচিতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমের সম্পর্কে। এদের অনেকে পরবর্তীতে ফোনে কথা বলা যুবকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর প্রতারিত হয়ে আবেগবশত এই কিশোরীরা কখনোবা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ।
শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ দূষণে অবদান রাখছে মুঠোফোনের যথেচ্ছ ব্যবহার। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকেÑএমন অভিযোগও প্রবল। এমনকি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের মুঠোফোনের ব্যবহার শৃঙ্খলা ভঙ্গের ক্ষেত্রে বাজে নজির রাখছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদফতরের অফিস আদেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও তারা মুঠোফোন কোথায় রাখবেন সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। মুঠোফোন আধুনিক জীবন ব্যবস্থার অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রায় শতভাগ মুঠোফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত।
মুঠোফোন নিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশে যেহেতু নিষেধাজ্ঞা নেই, কিংবা সময়ের বিবেচনায় এ ধরনের বাধা সৃষ্টি যেহেতু যুক্তিসঙ্গত নয়, সেহেতু শ্রেণিকক্ষের বাইরে সেগুলো কীভাবে রাখা যাবে, সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শিক্ষক লাউঞ্জে তাদের মুঠোফোন রেখে শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার যে সুযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুযোগ সৃষ্টির কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ইতিবাচক নির্দেশনাটির যথাযথ বাস্তবায়নে শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন সংরক্ষণের বিষয়টি সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে। নির্দেশ অমান্য করে কেউ শ্রেণিকক্ষে মুঠোফোন নিয়ে গেলে তাদের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করা দরকার।
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড
"