জাকির আজাদ

  ২০ জানুয়ারি, ২০২০

নিবন্ধ

স্নেহই শিশুর প্রথম প্রত্যয়

তানিসা নিজের ঘরে বসে আছে চুপচাপ। কারো সঙ্গে কথা নেই আজ তার। বাসার সবার বারণ তার সঙ্গে যাতে কেউ কথা না বলে। মা-ও তার ধারেকাছে ভিড়ছে না। অফিস থেকে বাবা এসেও তার কাছে গেল না। একটা ক্ষোভ মায়ের ভেতর। সেই সকালে নাশতার খাওয়ার পর এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে অথচ এখনো তার কোনো খাওয়া নেই। মা আজ খাওয়ার জন্য তাকে পীড়াপীড়ি করছে না। কারণ আজকাল সব ব্যাপারে তানিসা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। বানিয়ে বানিয়ে যতসব মিথ্যা কথা বলছে। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সঙ্গে মিথ্যা বলেছে তারা নাকি এ মাসেই বিদেশে যাচ্ছে তানিসার চতুর্থ জন্মদিন করার জন্য। তার এই মিথ্যা বলাটা মা-বাবার কাছে বিপজ্জনক মনে হচ্ছে। তাই তানিসার মায়ের সিদ্ধান্ত তার সঙ্গে কেউ কথা বলতে পারবে না, যতক্ষণ সে মিথ্যা কথা ছাড়তে না পারে। মায়ের কাছে এই শাস্তিটা লঘু হলেও তানিসার জন্য হয়ে গেছে গুরু শাস্তি।

শিশুরা নির্মল সৌন্দর্যের প্রতীক। অনেকে শিশুদের ফুলের মতো করে দেখেন। কেউ তুলনা করেন স্নিগ্ধ চাঁদের সঙ্গে। চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে, শিশুর শরীরে তাও নেই। শিশুর চরিত্রে নেই কোনো কালিমা। মায়ের কোলে আলো জ্বেলে সে দেখে তার নতুন পৃথিবী। মায়ের চোখে থাকে এক অনাগত স্বপ্ন। তার সন্তান বড় হবে। মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। একটি শিশুকে প্রকৃত অর্থে বড় করে তুলতে গেলে চাই শাসন ও সোহাগের সংমিশ্রণ। যেকোনো একটির আধিক্যই শিশুর জন্য মারাত্মক। ফলাফল হয়ে অবশ্যই মন্দ। দুরন্ত ও অবাধ্য শিশুকে শান্ত করতে বকাঝকার সঙ্গে অনেক পিতা-মাতা মারধরও করেন। আবার অতি আদরে কখনো শিশু হয়ে ওঠে জেদি ও একগুঁয়ে। অতিরিক্ত শাসন বা বাঁধনছাড়া আদর ও প্রশ্রয়ও যেমন শিশুর পক্ষে ভালো নয়; তেমনি যখন-তখন ভয় দেখালে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র শিক্ষক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল আনোয়ার বলেন, পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুদের শাসন করা উচিত নয়। এ সময়ে ওদের সঙ্গে সব সময় সমঝোতার মনোভাব নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। শিশুদের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলা বা জোরে ধমকানো একেবারে অনুচিত। হঠাৎ জোরে ধমক দিয়ে শিশুরা চমকে ওঠে, এতে করে ‘রিঅ্যাকটিভ সাইকোসিস’ হতে পারে। অর্থাৎ মনের ওপর এমন প্রভাব পড়ে যে, সামান্য শব্দেই ওরা ভয় পায়।

যদি শিশুদের ঘুম-পাড়ানো হয় ভূতের ভয় দেখিয়ে, তবে সে ভূত দেখেছে বললে আপত্তি করা চলে কি? প্রথম রূপকথার গল্প শোনা বয়সে সে মনের পক্ষীরাজ ঘোড়ায় কত তেপান্তরের মাঠে ঘুরে আসে, সেই কল্পনাবিলাসের ছিটেফোঁটা প্রকাশ করারও ইচ্ছা হতে পারে। মা, দাদির কোলঘেঁষে ছোট্ট খোকাখুকু আরব্য উপন্যাসের সহস্র রজনির কথা, পরীর গল্প, ডাইনি রাক্ষসের কাহিনি শুনে সেই জগতের পরিবেশে নিজেকে ধরা দিতে চায়। এ জগৎ তার কাছে আমাদের মতো অত জানাশোনা ব্যাপার নয়, তাই এ জগতে আর কল্পনার মিশে তার দুনিয়া একাকার। বলুক না দু-চারটে অলিক কল্পনার কথা। ঘাবড়ানোর কিছুই নেই। সব ছেলেমেয়েই বলে কম আর বেশি এই যা পার্থক্য। তার আজব কল্পনাকে হেসে বা ঠাট্টা করে দমিয়ে দেওয়া উচিত নয়। লজ্জায় হয়তো আর সহজ-সরল সঙ্গী হিসেবে নিতে পারবে না বড়দের সে এড়িয়ে যাবে, মনে করবে তারা তাকে বিদ্রুপ করে। চাই বিশ্বাস আর স্নেহ। বড়দের কাছে যদি সে নির্বিঘ্নতা আর নিশ্চিয়তা পায় নিজ থেকেই পরিবর্তন আসবে। হৃদয়ের বৃত্তিগুলোর সুস্থ ও সম্যক বিকাশের প্রথম ভিত এই স্নেহ-অন্ধ স্নেহ নয়, সেই স্নেহ যা থেকে শিশুর প্রথম প্রত্যয় আসবে।

কল্পনা ছাড়াও শিশুরা মিথ্যা বলে অযথা অহংকার প্রদর্শন করার ইচ্ছা একটা বয়সে আসতে পারে। বাড়ি-গাড়ির গল্প শুনিয়ে চমক লাগিয়ে দেওয়া যায়- এ কথা সে বড়দের থেকেই শেখে। বন্ধুবান্ধবের দৃষ্টিতে নিজেকে প্রকান্ড একটা কিছু প্রমাণ করতে দু-একটা মিথ্যার বেসাতি করে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, কোনো অপ্রাপ্যতা থেকেই এই মিথ্যার সৃষ্টি। স্কুলের পড়াশোনায় হয়তো তার অগ্রগতি নেই। হয়তোবা খেলাধুলায় সে প্রতিযোগী ছেলেমেয়ের সমান নয়। তাই অন্যত্র নিজের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণে ব্যস্ত। এমনও হতে পারে মনের ভেতর কোনো এক অজানা ভয় থেকে মিথ্যার জন্ম। এই ভয়কে জয় করতে অভিভাবকের স্নেহ ও ধৈর্য ভীষণ প্রয়োজন। কেন ভয়, কীসের ভয়, বাবা-মার জেনে নেওয়া যত সহজ; তেমন কি আর মনস্তত্ত্ববিদই জানবেন?

আবার শান্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শিশুরা মিথ্যা বলে। বিনা অনুমতিতে কোনো কাজ করে ফেলেছে, কাক্সিক্ষত শাস্তির থেকে মুক্তির জন্য চটজলদি মিথ্যা বলে দিল। তখন তার এই অস্বীকার নিয়ে যদি অযথা টানাহেঁচড়া করে শাসনে মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তবে ভবিষ্যতে হয়তো আরো সাবধানে গোপন করবে অথবা আগ্রাহ্য করতে শিখবে। অবশ্য কখনো একটু-আধটু মিথ্যা কথা ভুলে গিয়েও শিশুরা বলে। শিশুরা বাবা-মা বা প্রিয়জনের ভালোবাসা, অপত্য স্নেহ হারাতে চায় না, তাই এমন কাজ যা তাদের অসন্তোষের কারণ হতে পারে তার স্মৃতি নিজের অজ্ঞাতসাবে ভুলে যেতে চায়।

আসলে যেকোনো ধরনের মিথ্যাই হোক প্রিয়জনের আদর ও স্নেহ তার মূলে পরিবর্তন করতে পারে। বাড়িতে শিশুর সমাদর হলে সে নির্ভয় হতে পারে ও আত্মনির্ভরতা শেখে। আত্মনির্ভরতা সবচেয়ে বড় নির্ভরতা। কিন্তু কেবল কাজে নয়, চিন্তারও আত্মনির্ভর হয়ে তৈরি হয়ে উঠলে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝবে। আমাদের চিন্তাধারা আমাদের ভাােল-মন্দবোধ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আমরা অনেক সময় লিপ্ত থাকি। বাবা-মার অসফল আশা-আকাক্সক্ষা শিশুদের জীবনে সার্থকতায় রূপলাভ করুক- এমন ভাবধারণাও অলক্ষ্যে জন্মায়, তখন আমরা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনসত্তা তৈরির পথে অন্তরায়ও হয়ে যাই। নিজেদের প্রতিফলিত করার প্রয়াসে তাকে দমিত করতে সচেষ্ট থাকি।

আমাদের বিবেক তাকে ধার না দিয়ে তার বিবেকের জাগিয়ে দেওয়ার সহয়তা দিলে, সে এক দিন তার বিবেচনাশক্তি প্রখর করে তুলতে পারবে। মিথ্যা বললে শেষ পর্যন্ত ঠকতে হয়, এ কথা সে নিজেই থেকে হারে হারে বুঝবেই। বিবেক অন্তরের রক্ষী মনস্তত্ত্ববিদের ভাষায় Internalpoliceman তাকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সবল রাখতে সাহায্য করতে হবে। স্বয়ং সে সুস্থ মন নিয়ে গড়ে উঠবে। এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কনসালট্যান্ট সাইকয়াট্রিস্ট ডা. মোহিত কামাল বলেন, কোনো শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই তার মস্তিষ্কের বেশির ভাগ উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটে। এমনকি কী ঘটছে, তা অনেক প্রাপ্তবয়স্ক লোক বুঝে ওঠার আগেই নবজাত শিশুর মস্তিষ্ক-কোষগুলোর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। যে পয়েন্ট দিয়ে নিউরণ থেকে নিউরণে স্নায়ুর স্পন্দন পৌঁছায়, সেই সাইনাপসগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং জীবনকালের ধরনগুলো কী হবে, তা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাত্র ৩৬ মাস সময়ের মধ্যে শিশুদের ভাবনাচিন্তা ও কথা বলার, শেখার ও বিচার-বিবেচনার সামর্থ্য তৈরি হয়ে ওঠে। যা কি না প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই তাদের মূল্যবোধ ও সামাজিক আচরণের ভিত্তি গড়ে ওঠে।

আমাদের সমাজ হচ্ছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী, ধাবমান সব সময় আমরা বিজয়ী হতে চাই, অবচেতনভাবেই শিশুর মনের ওপরও বিজয়ী হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকি। যে শিশু নতুন কিছু শিখছে, নতুন দক্ষতা অর্জন করছে, তার ভেতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে প্রতিনিয়তই। আনন্দপ্রাপ্তির চেয়ে বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনার দাবি প্রয়োগ করলে তার স্বাভাবিক মনের বিকাশ স্বতঃস্ফূর্ত হবে না। বাধাগ্রস্ত হবে। এই চাপ এবং দাবি শিশুর। আত্মবিশ্বাসের মূল ধাপটি ভেঙে দেবে। মনে রাখতে হবে, নিজস্ব সাবলীল বেগবান ধারার মাধ্যমেই শিশু দক্ষতা অর্জন করবে, বিজয় ছিনিয়ে আনবে, আপন আনন্দের মাঝ থেকেই এই প্রাপ্তিই সবচেয়ে বড় সম্পদ।

যদিও জীবনের খুঁটিনাটিতে পার্থক্য থাকতে পারে, তবে সারা বিশ্বের শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের কোটি কোটি মাতা ও পিতার জন্য কিন্তু কাহিনিটি একই রকম। নিজ নিজ সন্তানদের জন্য সময় করে নেওয়া ও সময় ব্যয় করা, উদ্যম খাটানো এবং সম্পদ বৃদ্ধি করা। তাদের দিন কাটে সন্তানদের সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠা, সুরক্ষা দেওয়া, লেখাপড়া শেখানো, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া, তাদের মেধা উৎসাহিত ও কৌতূহল পূরণ করা, এবং উদ্দীপনা ও মার্জিত আচরণ অর্জনে সহায়তা প্রদান করার মধ্য দিয়ে। তাই তানিসা এই মিথ্যা বলার বদ-অভ্যাসটি একমাত্র স্নেহ-বাৎসল্যের মাধ্যমে নিরাময় করা উচিত।

লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close