এস এম নাজের হোসাইন

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

মূল্যবৃদ্ধি ষড়যন্ত্রের প্রতিরোধ চাই

সম্প্রতি ভারতে পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ করে দেওয়া ও মূল্য বাড়ানোর সংবাদে দেশে পণ্যটির মূল্য হঠাৎ করে দফায় দফায় বাড়লেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও জেলা প্রশাসন কোনো ধরনের উদ্যোগ না নিয়ে নীরব থাকায় জনমনে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি পেঁয়াজ নিয়ে এক আলোচনায় খাবারে পেঁয়াজের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা বারবার তাৎক্ষণিক দাম বাড়ালেও বিদেশে দাম কমলে তার প্রতিফলন দেশে হয় না, তখন উল্টো সুর বেশি দামে কেনা, লোকসান দিয়ে বিক্রি করব নাকিÑ এসব কথা শুনে থাকি? যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি হলে ইতিপূর্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন ওই খাতের ব্যবসায়ী ও ভোক্তা এবং প্রশাসনের লোকজনকে নিয়ে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ সভা করে বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করা, বাজার তদারকি জোরদার করে মজুদদারি ঠেকানো, টিসিবিকে দিয়ে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়ে অস্থিরতা দূরীকরণে উদ্যোগ নেওয়ার উদাহরণ থাকলেও ইদানীং ব্যবসায়ীদের ওপর সব কিছুর ছেড়ে দিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন দিবাস্বপ্নে বিভোর। এ অবস্থায় জনগণের অবস্থা ত্রাহি, ত্রাণকর্তা হিসেবে একমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া উপায় থাকছে না। এর আগে ব্যবসায়ীরা বাজেটে শুল্ক আরোপসহ নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ালেও সরকার বেশ কিছু পণ্যের বিষয়ে শুল্ক ছাড় দিলেও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে বাজারে সব রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এ অবস্থায় জরুরিভাবে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জেলা-উপজেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি, ক্যাব, গণমাধ্যম ও চেম্বার প্রতিনিধি সমন্বয়ে বাজার তদারকি জোরদার, জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরি সভা করে সম্ভাব্য করণীয় নির্ধারণ, বিকল্প উৎস থেকে এসব পণ্য আমদানি নিশ্চিত করা, বিকল্প বাজার হিসেবে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন দেশের ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশসহ (ক্যাব) বিভিন্ন সামাজিক, পেশাজীবী, রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠন।

সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের অজুহাতে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি প্রায় ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ভারতে রফতানি বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ ভারতে দাম কমলে ভোক্তারা তার সুফল পায় না। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অজুহাত, ভারতে পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্যে বন্যা হওয়ায় পণ্যটির দাম বেড়েছে। তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে হিলি বন্দরের পাইকাররা কারসাজি করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় যখনই কোনো পণ্যের সংকট তৈরি হয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপান আর খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপিয়ে জনগণের নাভিশ্বাস তৈরি করেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের আওতাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করে ঢাকা শহরে ট্রাকে কিছু পেঁয়াজ বিক্রি করলেও নিজেরা আন্তর্জাতিক উৎস থেকে আমদানি করে কোনো পেঁয়াজ আনেনি। ফলে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া টিসিবি জনগণের সংকটকালীন সাধারণ মানুষের জন্য উদ্ধারকর্তা হতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত অফিস ও জনবল এবং বিশাল বহরের ডিলারগুলো বেকার বসে অলস সময় কাটাচ্ছে। ক্যাব দীর্ঘদিন ধরে টিসিবিকে কার্যকর করা, বর্তমান প্রশাসনিক অবকাঠামোকে পুনর্গঠন করে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য দাবি জানালেও সরকার সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যার খেসারত সাধরণ জনগণকে দিতে হচ্ছে।

এদিকে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি না করে কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মাধ্যমে পণ্যটি আমদানির জন্য উদ্যোগ নেন। ফলে ব্যবসায়ীরা আজ, কাল এভাবে কালক্ষেপণের কারণে সমস্যাটি আরো ঘনীভূত হতে লাগল। বৃহৎ শিল্প গ্রুপের পেঁয়াজ এখনো দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। বিষয়টি আবারও ব্যবসায়ীদের হাতে পেঁয়াজের জন্য সরকারের আত্মসমর্পণ বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কারণ সরকার যদি নিজে পেঁয়াজ আমদানি করত, তাহলে ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের এত নির্ভরশীলতা বাড়ত না। মানুষের দুর্ভোগ সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছাত না। বাজার ও ভোক্তা খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ী কর্তৃক পণ্যের হাত বদল। কারণ যখনই হাত বদল হয়; তখনই লাভের অঙ্ক বেড়ে যায়। বৃহৎ আমদানিকারক ও শিল্প গ্রুপ যখন আমদানি করবে তারা, নিজেরা সরাসরি এগুলো বিক্রি করবে না, বিভিন্ন জন পাইকারিতে বিক্রি করবে আর তাদের মাধ্যমে হাত বদল করার ভেতর দিয়ে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে।

এ ছাড়াও একটি শুভঙ্করের ফাঁকি আছে পেঁয়াজের উৎপাদন ও ব্যবহার পরিসংখ্যন নিয়ে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ টন আর দেশে উৎপাদিত হয় ১৮ লাখ টন। বাদ বাকি ৮ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু সিংহভাগ দেশে উৎপাদিত হলেও দেশীয় পেঁয়াজের দাম সব সময় বিদেশি পেঁয়াজের চেয়ে বেশি থাকে। দেশীয় পণ্যটি বাজারে সব সময় সহজলভ্যও নয়। সে কারণে দেশীয় পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনের বিষয়ে পরিসংখ্যানটি কতটুকু সত্যি, তা যাচাই করা দরকার। বাজার ও ভোক্তা খাতের অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ভারতীয় গরু আমদানি করে কোরবানির গরুর বাজারে সংকট মোকাবিলার মতো দেশীয় গবাদিপশুর উৎপাদন বাড়িয়ে সংকট মোকাবিলায় পণ্যটির উৎপাদন বাড়িয়ে এ সংকট নিরসনের পরামর্শ প্রদান করলেও কৃষক যখন ঘরে পেঁয়াজ ঘরে তুলবেন তখন ভারতীয় ও অন্য উৎস থেকে পণ্যটি আমদানি বাড়লে দেশীয় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই দেশীয় চাহিদা ও উৎপাদনের যে রকম প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করতে হবে, একই সঙ্গে দেশীয় কৃষককে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য উৎপানকালীন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানিতে উচ্চহারে কর আরোপ করতে হবে। এ ছাড়াও প্রকৃত কৃষকের মাঝে প্রণোদনা হিসাবে স্বল্পসুদে ঋণ, ভর্তুকি প্রদান, কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য খাদ্যগুদাম, হিমাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।

পেঁয়াজ সংকট চলাকালে জেলা প্রশাসন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের সমন্বিত বাজার অভিযানকালে যে বিষয়টি বেশি করে দেখা গেছে তা হলো আমদানিকারক আমদানি করে আড়তদারদের হাতে পণ্য পৌঁছানোর সময় তাদের হাতে কোনো রসিদ দেয় না। অনেকের মতে, যে ট্রাকে করে আমদানিকারক পেঁয়াজ আড়তদারদের কাছে পাঠায়, তারা বিক্রি করে ওই ট্রাকে করে টাকা পাঠায়। তারা জানেন না কে আমদানিকারক ও কত টাকা আমদানি মূল্য। আবার অনেকে আমদানিকারকদের কাছে টাকা পাঠান, কিন্তু নাম-ঠিকানা জানেন না। বিষয়টি অনেকটাই অদৃশ্য ব্যবসার মতো। রসিদ, আমদানি মূল্য ও আমদানিকারকের নাম-ঠিকানা ছাড়া যদি কেউ পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন; তাহলে এটা অদৃশ্য ব্যবসা ছাড়া কিছু হতে পারে না। তাই পেঁয়াজ আমদানিকারক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায় এ ধরনে অদৃশ্য ব্যবসাকে একটি কাঠামোর মধ্যে না আনা হলে কৃত্রিম সংকটের এই সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙা সম্ভব হবে না। মজার কাহিনি হলো, টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ৪২ টাকা হলেও পাইকারিতে মূল্য ৯০-১০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা তাদের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে পেপারলেস এ ধরনের কারসাজিতে লিপ্ত।

সাধারণ মানুষের জনদুর্ভোগ লাগবে কার্যকরী ও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও সমন্বিত বাজার তদারকি কার্যক্রম একটি উদ্ভাবনী মডেল চলমান ছিল। যেখানে জেলা-উপজেলা প্রশাসন সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করলেও বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের মতো অতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে প্রশাসনের দৃষ্টি না থাকায় তারা সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ লাগবে উদ্যোগ নিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় দুর্ভোগ লাগবের বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যাচ্ছে। বাজার তদারকিতে বর্তমানে চলমান অভিযানটি অনেকেই লোক দেখানো ও দায়সারা গোছের বলছেন। কারণ বর্তমান বাজার তদারকিতে দেখা যাচ্ছে, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বাজার পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিচ্ছে না, প্রশাসনের নানাবিধ কাজে জড়িত থাকায় বাজারে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে অভিযান পরিচালনার সময় থাকে না। ফলে অনেকটাই দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করে দু-একটি জরিমানা করেই কাজ শেষ করতে চান অনেকে। আবার মোবাইল কোর্ট আইন বা অন্যান্য আইনও বলা আছে ফলোআপ করা। অর্থাৎ আজকে যে অপরাধের জন্য একজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হচ্ছে, তাকে পর্যবেক্ষণে রাখা সে পরবর্তীতে কী করছেন? ব্যবসায়ীরা অনেক সময় মোবাইল কোর্টে জরিমানা দিতে আগ্রহী, কারণ সে বিশ্বাস করে যদি আজকে জরিমানা প্রদান করা হয়, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তার দোকানে এক মাস আসবেন না। ফলে সে আবারও আরো বেপরোয়া হয়ে অপরাধ সংগঠনে লিপ্ত হতে পারবেন। ফলে সমন্বিত বাজার তদারিকর মতো সরকারের অনেক উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুফল তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপভোগে সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে যে যেভাবে পারে লুটপাট করছেন, জনগণের পকেট কাটছেন, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন নীরব দর্শক। প্রশাসনের নীরবতায় সর্বত্রই মনে হচ্ছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের লুটপাটের রাজত্ব। বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের নানা সভার সিদ্ধান্ত শোনা গেলেও তার কার্যকারিতা কতটুকু, তার নিরপেক্ষ তদন্ত অনুসন্ধান প্রয়োজন।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close