মযহারুল ইসলাম বাবলা

  ২২ অক্টোবর, ২০১৯

পর্যালোচনা

পাড়া সংস্কৃতি ফেরাতে হবে

পাড়া-মহল্লায় এমনকি গ্রামে বসবাসরত প্রতিবেশীদের মধ্যকার নিবিড় সম্পর্ক-সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠেছিল; একই অঞ্চলে বসবাসের সুযোগে। সামাজিক জীবনাচারে অভ্যস্ত মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই আচারই পাড়া সংস্কৃতি। দেশের শহরগুলোতে স্থানীয়দের বসবাস বংশানুক্রমিক। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রতি পরিবার ও ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক ছিল। যেমনটি গ্রামে ছিল এবং আছেও, তবে আগের তুলনায় কিন্তু ভাটির টান পড়েছে। শহরে তো এখন পাড়া সংস্কৃতি বলে অবশিষ্ট কিছু নেই। এমনকি আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতার অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছে। প্রত্যেকে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামষ্টিক সামাজিকতার ধার আর কেউ ধারে না। যার যার, তার তার অবস্থা।

দেশের পুরাতন শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে এবং গ্রামেও সামাজিকতার সম্পর্ক-সম্প্রীতি আগের তুলনায় কম হলেও এখনো আছে। কিন্তু শহরে সেটা একেবারেই নেই। অথচ পেশা ও জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ শহরমুখী হওয়ার পর শহরের পরিসর বৃদ্ধিতে শহরের মানুষের সংখ্যাও বেড়ে যায়। গড়ে ওঠে নতুন শহর, নতুন নতুন আবাসিক এলাকা। এই নতুন শহরগুলোতে বসবাসকারীরা সবাই দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম থেকে আগত। পরিবার নিয়ে তারা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি আবাসিক এলাকা ও কলোনি গড়ে ওঠে। অঞ্চলভেদে প্রতি পাড়ায় বসবাসকারীদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের নিবিড় সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়। সেটা অভিভাবক থেকে সমবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করে। প্রতিটি পাড়ায় ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে তরুণ-যুবকদের ক্লাব। এই ক্লাবকে কেন্দ্র করে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও পাঠাগার গড়ে ওঠে। অর্থাৎ একটি সাংস্কৃতিক দৃশ্যমান বলয়ের সৃষ্টি হয়। প্রতি পাড়ায় মাঠ ছিল। ছিল সুপরিসর খোলামেলা স্থান। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, আবৃত্তি, বিতর্ক, দেয়াল পত্রিকা, সংকলন প্রকাশ, বার্ষিক নাটক মঞ্চায়ন-বিচিত্রানুষ্ঠান প্রভৃতি কর্মকান্ডে ছিল মুখরিত। শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়ায় সামাজিকতার প্রাণবন্ত পরিবেশ বিরাজ করত। পাড়া সংস্কৃতির মাধ্যমেই প্রজন্মান্তরে দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াবিদ অজস্রজনের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের সবাই সে কথা অকপটে স্বীকারও করেন। পাড়া সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বিকশিত আমাদের খ্যাতিমানদের তালিকা কিন্তু মোটেও ক্ষুদ্র নয়, বরং সংখ্যাধিক্য।

ধর্মীয় সামাজিক উৎসব-পার্বণে সবাই সবার বাসায় যাওয়াও ছিল অনিবার্য। কোরবানির ঈদে এককভাবে কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য চাকরিজীবীদের তখন ছিল না। একে তো বৈরী পাকিস্তানি শাসক, তার ওপর অবাঙালিদের দৌরাত্ম্যে বাঙালি সরকারি, আধাসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তখন ছিল কোণঠাসা অবস্থায়। পাড়ায় পাড়ায় ভাগে কোরবানি দেওয়ার প্রচলন ছিল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সব কিছুর বিনিময় ছিল অপরিহার্য। এই সামষ্টিক সামাজিকতায় নিজেকে অনিরাপদ ভাবার সামান্য অবকাশ ছিল না। ছিল না একাকিত্বের অসামাজিক জীবনযাপনও। পাড়া সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মধ্য ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক মানবিক সমাজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে দ্রুতগতিতে সেই সামষ্টিক সামাজিকতা লোপ পেতে পেতে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই।

গ্রামে যেমন সবাই সবাইকে চেনে-জানে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এখন গ্রামেও প্রজন্মান্তরে সবাই আর সবাইকে চেনে না। ঠিকুজি জানার পর হয়তো চেনে। গ্রামগুলোতেও ছিল এক বা একাধিক ক্লাবঘর। সেখানে খেলাধুলার পাশাপাশি নানাবিধ সাংস্কৃতিকচর্চার ক্ষেত্র উন্মুক্ত ছিল। এখন পেশা ও জীবিকা গ্রাম বা জেলা শহরকেন্দ্রিক থাকলেও সন্তানদের শহরের উন্নত-আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার অভিপ্রায়ে গ্রাম ত্যাগ করে শহর অভিমুখে ছুটছে তারা। এতে সাংস্কৃতিকভাবে গ্রাম আরো দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত সাংস্কৃতিক বিনোদন প্রায় পরিত্যক্ত। অতীত আর বর্তমানের গ্রামের সংস্কৃতিগত ভিন্নতা মোটা দাগে দৃশ্যমান। প্রযুক্তির উন্নয়নের ছোঁয়া শহর পেরিয়ে গ্রামে প্রবল বেগে বিস্তার লাভ করেছে। আমরা ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক যান্ত্রিক জীবনাচারে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছি। গ্রামও সেই রাহুমুক্ত কিন্তু আর নেই।

শহরের যে পাড়া সংস্কৃতি ছিল, সেটা ফ্ল্যাট সংস্কৃতির প্রবল প্রভাবে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় টিকতে পারেনি। বিলীন হয়ে গেছে। শহরের সর্বাধিক বাড়ি ছিল একতলা-দোতলা। সরকারি কলোনিগুলো সর্বাধিক তিন তলা। এখন শহরে বহুতল অট্টালিকায় চাপা পড়েছে শহরের অতীত সংস্কৃতি-সামাজিকতা। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাস করলেও কারো সঙ্গে কারো সামাজিক সম্পর্ক নেই। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে কেউ কারো নয়। সবাই নিজ পরিবারকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ। শহরে এখন মাঠ খুঁজে পাওয়া যায় না। নেই উন্মুক্ত খোলামেলা স্থানও। পুঁজিবাদী উন্নয়ন সবই গ্রাস করে নিয়েছে। শহরের সঙ্গে নদী সংযোগ খালগুলো ভরাট করে কিংবা সংকুচিত করে কালভার্ট নির্মাণ করে ড্রেনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পয়ঃবর্জ্য, বৃষ্টির পানি নির্গত হতে না পারার কারণে নানাবিধ সংকটের মধ্যে আটকা পড়েছে শহরের মানুষ। দেশের প্রতিটি শহর নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ। নিরুপায়ে মানুষ শহরে এক অমানবিক যান্ত্রিক জীবনাচারে জীবন অতিক্রম করছে। সড়কে সড়কে তীব্র যানজটে মানুষের কর্মঘণ্টা ক্ষয় হচ্ছে। শহরের নাগরিকদের নাগরিক সুবিধা প্রদানে নানা সংস্থা থাকলেও বাস্তবে নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত শহরের মানুষ। এসব দুরবস্থা থেকে পরিকল্পিত উপায়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় নেই। কেননা রাষ্ট্র, সরকার এবং নগরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, স্থানীয় সরকারের ন্যূনতম উদ্যোগ-পরিকল্পনা বলে বাস্তবে কিছুই নেই।

আমাদের সমাজজুড়ে অস্থিরতা, নৈরাজ্য, হত্যা, শিশু ও নারী হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণ-গণধর্ষণের নৃশংস ঘটনা অবিরাম ঘটে চলেছে। এই ভূখন্ডের অতীত ইতিহাসে এমন নজির কখনো ছিল না। স্বজাতির হাতে স্বজাতির এমন নিষ্ঠুরতা, শোষণ-নিপীড়ন, অমানবিকতা আমাদের ইতিহাসে নিশ্চয় নতুন সংযোজন। আমাদের সমাজে বিচ্ছিন্নতা এবং সামগ্রিক সাংস্কৃতিক মান নিম্নমুখী হওয়ায় সাংস্কৃতিক শূন্যতায় তরুণ-যুবকরা সংস্কৃতিহীন বেকারে পরিণত। তাদের সামনে স্বপ্ন নেই, নেই ভবিষ্যৎ। বিপদগামিতার মূলে এই কারণগুলোকে অস্বীকার করা যাবে না।

অতীত সমাজে সামষ্টিক সামাজিকতা এবং সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছিল। সে কারণে তরুণ-যুবকরা রাজনীতি সচেতন হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল। রাজনীতি এখন পেশা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। দ্রুত অর্থবিত্ত লাভের অবলম্বনই হচ্ছে রাজনীতি সম্পৃক্তি, বিশেষ করে শাসক দলের সম্পৃক্ততায়। আমাদের শাসকশ্রেণি উদ্দেশ্যমূলক উপায়ে তরুণদের রাজনীতিবিমুখ করে দলবাজির বৃত্তে নানা সুবিধা প্রদানে বৃত্তবন্দি করে ফেলেছে। এতে মানুষের মুক্তির যে রাজনীতি, সেটা আর সক্রিয় থাকতে পারেনি। এক প্রকার গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে জনগণের মুক্তির সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সব কর্মকান্ডকে।

প্রশ্ন থাকে আমাদের সামাজিক জীবন ১৮০ ডিগ্রি উল্টে যাওয়ার মূল কারণটি কী? অনেকে বলবেন, কালের বিবর্তন। সেটা স্বীকার করলেও বিবর্তনের মূল রোগটি শনাক্ত করা কঠিন কিন্তু নয়। ব্যাধিটি হচ্ছে বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে চলেছে। যার প্রভাব কেবল পাড়া সংস্কৃতিকে নির্মূল করেনি। নির্মূল করেছে প্রত্যেকের আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যকার সম্পর্ক-সম্প্রীতিকেও। পুঁজিবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নতির ইঁদুর দৌড়ে আমরা অবিরাম ছুটছি। পুঁজিবাদের মৌলিক দর্শনই হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় সীমিত। পুঁজিবাদ সমষ্টির উন্নতির আদর্শ ধারণ করে না। সমষ্টির ওপর ব্যক্তির শোষণকেই উৎসাহ জোগায়। তাই সর্বাগ্রে জরুরি রোগটি চিহ্নিত করে রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। অর্থাৎ বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বদল না ঘটানো পর্যন্ত আমাদের সমষ্টিগত মুক্তির কোনো উপায় নেই। তাই পুঁজিবাদবিরোধী গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা যেমন আবশ্যক, তেমনি অপরিহার্যও।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close