আহমেদ আমিনুল ইসলাম

  ০৭ মে, ২০১৯

মতামত

আমরা সতর্ক আছি তো?

পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। অমানবিক হলেও সেখানকার সেসব ঘটনা আমাদের খুব একটা আকৃষ্ট করে না। কারণ, সেসব দেশে এটাই নৈমিত্তিক ঘটনা! এরূপ ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে ঘটলে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি। গৃহযুদ্ধ অবসানের পর শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে যখন নিজে শক্ত এক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর প্রয়াসে মনোযোগী; তখন সেখানে ঘটে গেল ভয়ংকর এক মানবিক বিপর্যয়। এ বিপর্যয় সৃষ্টির পশ্চাতে যারা কাজ করেছে তারা ধর্মীয় উগ্রপন্থি আইএস নামে বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত। সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কায়েমের মাধ্যমে তারা ধর্মকে ‘প্রবলভাবে’ প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাসে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে কখনো কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং মানবিকতার অভাবে এবং আচার-সর্বস্বতার কারণে পৃথিবী থেকে অনেক ধর্মের যেমন বিলুপ্তি ঘটেছে; তেমনি বিলুপ্তি ঘটেছে অনেক জাতিগোষ্ঠীরও। এ ছিল ধর্মকে নিয়ে বাড়াবাড়ির ফল। আইএস নামধারীরা যে ধর্ম প্রচারে উৎসাহী অথবা যে ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে হত্যা, সন্ত্রাস তথা চরম জঙ্গিবাদকে অবলম্বন করে অমানবিক ও নৃশংসতার পথ ধরেছে, সে ধর্ম কোনো ধর্ম?

ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণী এবং আইএসের কর্মকান্ডের মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান। নিশ্চয়ই এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য, অন্য কোনো লক্ষ্য। প্রকৃত অর্থে এর সঙ্গে পবিত্র ইসলাম ধর্ম কোনোভাবে যুক্ত নয়, হতেও পারে না। ইসলামকে আমরা জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে শান্তির ধর্ম বলেই জানি। সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে সবাইকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করাই ইসলামের মৌল চেতনার পাঠ। এরূপ চেতনা থেকেই আমাদের দেশে রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের সূত্রপাত দেখি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে। বাঙালির হাজার বছরের শাশ^ত ঐতিহ্য জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সৌহার্দ রক্ষা করে চলা, সমাজে বসবাস করা।

সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ থেকে আমরা কী শিক্ষা পেলাম? এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষাইবা আমরা নেব, আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য? একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আইএস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্ত ও স্থিতিশীল পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারছে না। মেনে নিতে পারছে না মানুষে মানুষে সৌহার্দপূর্ণ মানবিক সম্পর্ককেও। উপরন্তু তারা এ অঞ্চলে নিজেদের একটি শক্তিশালী দুর্গ প্রতিষ্ঠায়ও তৎপর। জননেত্রী শেখ হাসিনার জঙ্গিবাদবিরোধী ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস নজরদারি ও পেশাদারিত্বকে পাশ কাটিয়ে আইএস এ অঞ্চলে কার্যক্রম সক্রিয় রাখায় তেমন সুবিধা করতে পারছে না। মাঝে মধ্যে দুয়েকটি হামলার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে মাত্র। কিন্তু এই অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মধ্য দিয়েই ব্যাপক বিপর্যয়ও তারা সৃষ্টি করে চলেছে।

গত ২১ এপ্রিল ‘ইস্টার সানডে’র খ্রিস্টধর্মীয় প্রার্থনা অনুষ্ঠানসহ শ্রীলঙ্কার দেশি-বিদেশি মালিকানাধীন একাধিক আবাসিক হোটেলে পরিকল্পিত হামলা চালায় আইএস। হামলার দুই দিন পর তারা ভিডিওবার্তার মাধ্যমে এ সংবাদ নিশ্চিত করে। শ্রীলঙ্কায় আইএসের সাম্প্রতিক হামলা থেকে আমাদের আরো একটি বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে। তা হলো দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতা। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় দেশটির পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে সেই আলোচনাই প্রবল। শুধু শ্রীলঙ্কাতেই নয়, এই আলোচনা বরং বিশ্বব্যাপী। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সুরক্ষার অভাবে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর শান্ত হয়ে আসা শ্রীলঙ্কায় আইএসের এ হামলা শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিñিদ্র রাখার বিষয়ে মনোযোগী হওয়ারও একটি শিক্ষা আমাদের দিয়েছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের জন্যই একটি স্থায়ী ও টেকসই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। উপরন্তু আইএসের ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাব্য উপযোগী স্থানগুলোকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত ও কার্যকর করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক কোনো সংঘ স্থাপনও জরুরি হয়ে উঠেছে বলে আমরা মনে করি। যে সংগঠনটি কেবল জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে এলিট বাহিনীর মতো কাজ করবে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, মাদক ও সন্ত্রাসী হামলা বা হামলার আশঙ্কা-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বিনিময় এবং সেসব আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে কাজ করবে।

আমরা সব সময়ই শঙ্কিত থাকি এই ভেবে যে, না জানি কখন কোন আত্মঘাতী হামলার শিকারে পরিণত হই! আন্তর্জাতিকভাবে আঞ্চলিক কোনো সহযোগিতার ফোরাম গঠনের আগে নিজেদের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে সর্বক্ষণ সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে। বহু সংস্থা সতর্ক আছে জানি, তবু নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমাদের মনে বাসা বাঁধে আতঙ্ক। তাই সতর্কতা অবলম্বনে কোনো ধরনের শৈথিল্য গ্রাহ্য করা হবে নাÑ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এরূপ নির্দেশনা থাকাও তাই অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট, বড় ও মাঝারি বিভিন্ন মাত্রার জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেসব হামলায় মৃত্যুবরণও করেছে অনেকে। আমাদের সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রতি আক্রমণে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেও আমরা শুনেছি। কিন্তু এ নিয়ে আত্মতুষ্টির অবকাশ নেই। বরং সতর্ক অবস্থানে সর্বদা নিজেদের প্রস্তুত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রায় সময়ই বলে থাকেন ভৌগোলিক এবং আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় আইএস যেকোনো মূল্যে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা তাদের জন্য সেই সুযোগটি কতটুকু প্রসারিত রাখব? আমরা কোন জঙ্গি সংগঠনকে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে দেশটিকে অমানবিক রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব, নাকি তাদের দমন ও প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে মানবিক রাষ্ট্রের উদার বৈশিষ্ট্যগুলোকে সমুন্নত রাখব? নিশ্চয়ই আমরা একটি উদার ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকতে চাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে থেকে বাংলাদেশকে উন্নয়নের দীর্ঘ পথে এগিয়ে নিতে হবে, একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

দুই.

ইস্টার সানডের সেদিনের রোববারটি শ্রীলঙ্কাবাসীর জন্য হতে পারত অন্যরকম। অন্যরকম আমেজ-আবহে শুরুও হয়েছিল ‘সেই রাববার’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানকার আনন্দ আমেজ ও আবেগের স্ফূর্তি এক ভয়াবহ ঘটনায় রূপ নিয়েছিল। শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, সমগ্র বিশ্ব রক্তাক্ত দেশটির মানবিকতার বিপর্যস্ত অবয়ব দেখে হতভম্বই শুধু নয়, বিস্মিত হয়েছে! গির্জায় প্রার্থনারত সাধারণ মানুষ কিংবা হোটেলে থাকা দেশি-বিদেশি অতিথিদের অপঘাত মৃত্যুতে যে ভয়াবহ আর্তনাদ উচ্চকিত হয়েছিল, তা দেখে বিশ্ববিবেক হাহাকার করে উঠেছে! বিশ্ববাসী একদিকে শোক ও অন্যদিকে হামলাকারী ঘাতক নরপিশাচদের বিবেকবোধ জাগৃতির লক্ষ্যে মহাশক্তিধর ঈশ্বরের করুণা বৃষ্টি কামনা করেছে। ইস্টার সানডে উপলক্ষে চার্চে প্রার্থনারত অগণন ভক্তের ওপর কারা আচম্বিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, মানুষ সে বিষয়ে তখন অস্পষ্ট ধারণা করলেও পরে হামলাকারীরা নিজেরাই আত্মপরিচয় প্রকাশ করেছে। যদিও এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তার আগেই মানুষ সন্দেহের তীর তাদের দিকেই নিক্ষেপ করেছিল।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ধর্মের প্রাবল্যে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ’। ইতিহাস সাক্ষী বিশ্বব্যাপী এরূপ ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের পশ্চাতে রবীন্দ্রনাথকথিত ‘প্রবল ধর্মই’ কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। আইএস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠায় মানবিক বোধ হারিয়েছে, তা আমরা জানি না। ২১ এপ্রিলের হামলায় ৩৫৯ জন মৃত্যুবরণ করেছে। আহত হয়ে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। সাধারণের সহজাত বিবেকবোধ থেকে এ প্রশ্নই উঠে আসেÑ কেন এই হত্যাকান্ড? কেন প্রাণের এত ক্ষয়? মানুষের প্রতি মানুষের কেন এই রক্তাক্ত জিঘাংসা? কী অপরাধ ছিল গির্জায় প্রার্থনারত মানুষগুলোর? কী অপরাধইবা ছিল বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে যাওয়া শিশু জায়ানের? কী অপরাধে এত অল্প বয়সে বোমার আঘাতে মৃত্যুর অভিজ্ঞতায় সিক্ত হতে হলো তাকে?

মর্মাহত ও শোকগ্রস্ত শ্রীলঙ্কাবাসীর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনের ভাষা নেই আমাদের। শুধু অনুরোধ করব, তারা ধৈর্য ও সহনশীলতার মধ্য দিয়ে এ বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবেন। মনে রাখবেন, যারা গোপনে মানুষের ওপর হামলা চালায় তারা কাপুরুষ, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। কাপুরুষ বলেই তারা আত্মঘাতী। মানবসভ্যতার ইতিহাস নরপিশাচ এসব ঘাতককে ক্ষমা করবে না। এদের জন্য অপেক্ষা করছে প্রকৃতির প্রতিশোধ! এরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সব রাষ্ট্র থেকে, মানবিক বিশ্ব থেকেও। এদের জন্য করুণা ও ঘৃণার কোনো শেষ নেই! করুণা ও ঘৃণার অবকাশে বলি, সব ধর্মের যিনি স্রষ্টা তিনি যেন পথভ্রষ্টদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মের সারটুকু রেখে পাশবিকতার ‘প্রবল শক্তি’র বিনাশ করেন। তাদের মধ্যে মানবিক বোধ জাগিয়ে দেন।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close