রেজাউল করিম খান

  ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

পর্যালোচনা

বাংলা নববর্ষ : প্রয়োজনে উৎসবে

সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর, অনেকেরই দৃষ্টিগোচর হয়নি। কারণ খবরটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু যেহেতু রোববার বাংলা বছরের প্রথম দিন। আর দিনটি বাঙালিজীবনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, তাই এই সম্পর্কিত খবরের গুরুত্ব আছে বৈকি। খবরটি হচ্ছে, এবারের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে যশোরের ২০টি সাংস্কৃতিক সংগঠন। জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার আলম খান দুলু বলেন, রাজধানীর বাইরে যশোরেই সবচেয়ে সাড়ম্বরে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। বিখ্যাত মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরুও যশোর থেকেই। এবারের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আড়ম্বরপূর্ণ করতে দুই মাস ধরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রস্তুতি নিয়েছে। সরকার যদি তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তা হলে যশোরে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান বর্জন করা হবে। সরকার সম্ভবত সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ায়নি। উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানও বর্জন করেননি। তবে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, নিকট অতীতে অনুষ্ঠানগুলোতে জঙ্গিদের যে ভয়াবহ হামলা হয়েছে, সেই কারণে প্রশাসন নিরাপত্তার কারণে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতেই পারে। অপরপক্ষ বলছে, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এর জন্য অনুষ্ঠানের সময় কমানো উচিত নয়।

এ সময় বর্ণহীন আকাশে সোনা রং সূর্য আগুন ছড়ানোর কথা। চৈত্র শেষে হু হু করে বেড়ে যায় উষ্ণতা। এবার ঠিক তেমনটি নেই। অবশ্য কেটে গেছে শীতের জড়তা। বসন্তও নিয়েছে বিদায়। বৃক্ষশাখায় নতুন পাতার বাহার। পুরোনো পাতারা গেছে নিঃশেষে ঝরে। আসছে নতুন বছর। শুরু হবে জীবন ও জীবিকার নতুন সোপান। কিন্তু এবারের চৈত্রে মেঘের ঘনঘটা ছিল। বজ্রবৃষ্টির সঙ্গে হয়েছে কালবৈশাখী। দিনে দাবদাহ না থাকায় রাতগুলো ঈষদুষ্ণ।

বাংলা সনের হিসেবে পহেলা বৈশাখ নতুন বছরের শুরু। এককালে প্রজাদের বার্ষিক খাজনা পরিশোধের মাস এই বৈশাখ। চাষি প্রজাদের ঘরে এই সময় নতুন ধান। হাতে নগদ পয়সা। মনে তাই অনাবিল শান্তি। চোখে-মুখে আনন্দের নিঃসংকোচ বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু গ্রামগঞ্জে আনন্দের উপকরণ সীমিত। তাই জমে উঠে বৈশাখী মেলা। জারি-সারি-বাউল-মারফতি গানের জমজমাট আসর। লাঠি, কাবাডি, বদন কানামাছি খেলার উত্তেজনাময় প্রতিযোগিতা। সময় কম। বৃষ্টি এলেই চাষিদের ফিরে যেতে হবে ফসলের মাঠে। অতএব যত বেশি পার অবগাহন করে নাও আনন্দের বন্যায়। সারা বছর কঠোর কর্মভারে জর্জরিত এ দেশের প্রজাসাধারণ এই মাসেই খুঁজে পায় কিছুটা সুখ।

প্রজার কথা উঠলেই ওঠে রাজার কথা। পৃথিবীর প্রায় সব সন-তারিখই পরিগণিত হয়ে আসছে রাজার প্রয়োজনে বা পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলা সন প্রবর্তনের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। চাষিরা ফসল আবাদ করেন। সময় হলে কেটে আনেন ঘরে। সেই ফসল বিক্রি বা বিনিময় করে প্রয়োজন মেটায় সংসারের। পুত্র পরিজনও এর বেশি আশা করে না। কিন্তু রাজা আশা করে। যুদ্ধ জয় করে যে রাজা বসেছে সিংহাসনে তার তো প্রয়োজন অনেক। সে প্রয়োজন মেটাতে হবে প্রজাকেই। সুতরাং দাও খাজনা। সেই খাজনা নির্ধারণের জন্য পরিমাপ হলো জমি। কিন্তু আদায়ে বাধল গোল। সারা বছরই তো আর খাজনা আদায় করা যায় না। ঠিক হলো চান্দ্র মাসের হিসেবে খাজনা আদায় করা হবে। কিন্তু ফসল তো আর চাঁদের নিয়মে হয় না। মূল্যবান ফসল উৎপাদিত হয় বছরে একবারই। এই জটিলতা নিরসন করতে হবে। রাজা ডাকলেন পরিষদবর্গকে। বসলেন পন্ডিতদের সঙ্গে। ঠিক হলো আমাদের দেশের উপযোগী করে চালু করতে নতুন সন। নির্ধারিত হলো বৈশাখ বছরের প্রথম মাস। সেই থেকে বাংলা বছরের শুরু। উদ্দেশ্য কিন্তু একটাই, প্রজাদের উৎপাদিত ফসলের ভাগ নিয়ে রাজার কোষাগার পূর্ণ করা।

মুঘল আমলে ভারতবর্ষে হিজরি সন প্রচলিত ছিল। হিজরি চান্দ্র সন প্রতি বছর সৌর সনের চেয়ে ৯-১০ দিন এগিয়ে যেত। এতে খাজনা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা অসুবিধা হতো। সম্রাট আকবরের নির্দেশে রাজ জ্যোতিষী পন্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের দিন অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সন (ইংরেজি ১৫৫৬ সনের ১১ এপ্রিল) থেকে বাংলা বছরের হিসাব শুরু করলেন। সেই দিন থেকে পহেলা

বৈশাখ বাংলা সনের নববর্ষ। বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমনÑ বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া

থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ণ অর্থ বর্ষ বা ধান।

যে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হোক না কেন, সুদীর্ঘকালের ব্যবহারিক প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে এ সন বাঙালি জাতীয় জীবনের সত্তামূলে স্থান করে নিয়েছে। নববর্ষকে উপলক্ষ করেই জন্ম হয়েছে এক মহান ঐতিহ্যের। আমাদের গ্রামীণ জীবনে আনন্দের উপকরণ নিতান্তই সীমিত। আর তাই নববর্ষের উৎসবে মানুষ মেতে উঠে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসে। খুঁজে পায় বৈচিত্র্যের স্বাদ। গ্রামগঞ্জে বসে নানা বর্ণের মেলা। গীত ও গাঁথায় বীরত্বের কাহিনি শুনে মানুষ হয়ে উঠে সাহসী। প্রেম উপাখ্যানে হৃদয় হয়

চঞ্চল। শোকগাথা শ্রোতাদের মনকে করে তোলে উদ্বেলিত। মেলাতেই ঘটে গ্রামীণ শিল্পকর্মের এক অপূর্ব সমাবেশ। নতুনের আগমনে সাজগোছ। এই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। হতদরিদ্র মানুষের জীবন থেকে আনন্দ অনেকটাই বিদায় নিয়েছে। জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর অর্থনৈতিক মুক্তি, আমাদের কাছে এখনো স্বপ্ন হয়ে আছে, তা যদি অর্জিত না হয়, তা হলে সব ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আনন্দের উপকরণ গোষ্ঠীগত হয়ে যায়। উৎসব-অনুষ্ঠান সর্বজনীন হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close