মাহমুদুল হক আনসারী

  ১১ মার্চ, ২০১৯

মতামত

বিআরটিএ ও সড়ক দুর্ঘটনা

সড়কে শৃঙ্খলার জন্য বিআরটিএ একটি অপরিহার্য কর্তৃপক্ষ। সড়কের শৃঙ্খলা কোনোভাবেই আনা যাচ্ছে না। গণপরিবহনে এমন কোনো দিন নেই সড়ক দুর্ঘটনায় মূল্যবান জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে না। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই সড়কের জীবনহানির সংবাদ চোখে পড়ে। দেশের কর্মমুখী জনগণ, শিক্ষার্থীদের জন্য সড়ক ও পরিবহন এখন এক ধরনের অনিরাপদ গন্তব্যে পরিণত। প্রতিদিন অসংখ্য সংবাদ, লেখা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রতিকারের জন্য ছাপা হচ্ছে। বাস্তবে দেখা যায়, কোনোভাবেই সড়কের শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী, সেটা সমাজ চিন্তকদের খুঁজে বের করা এখন শুরু হয়েছে। যেভাবেই হোক জনগণের চলাচলের সড়ককে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শৃঙ্খলায় আসতে হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সারা দেশের বিআরটিএর কার্যালয় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত।

ঘুষের অর্থে গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়। শক্তিশালী পরিবহন সেক্টরের সংগঠনের কতিপয় নেতার সিন্ডিকেট জগদ্দল পাথরের মতো বসে আছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে এ সেক্টর পরিচালিত হচ্ছে। বিআরটিএর অসাধু একটি গ্রুপ তাদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক, অযোগ্য, অদক্ষ চালকদের অবৈধ অর্থের লেনদেনে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এ জন্য সারাে দেশে বিআরটিএর অনেকগুলো দালাল চক্রের তৎপরতা দেখা যায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এভাবেই পরিবহন সেক্টরকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে রেখেছে। শত শত কোটি টাকা এখানে অবৈধভাবে লেনদেন হয়ে আসছে। ট্রাফিক পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাও এসব অনৈতিক লেনদেনে জড়িত। ফলে সড়কের শৃঙ্খলা, দুর্ঘটনা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

রাস্তার শৃঙ্খলার জন্য ট্রাফিক পুলিশের যে দায়িত্ব সেটাও যথাযথভাবে পালন করতে দেখা যায় না। সারা দেশের সড়কগুলোর দুই ধারে গাড়ি পার্কিং, বিল্ডিংসামগ্রী স্তূপ করে থাকতে দেখা যায়। দিনের বেলায় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান সড়কে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে চলাচলে দেখা যায়। এসব গাড়ি টোকেন এবং ট্রাফিক পুলিশের বাণিজ্যে অনেকটা চলাচল করে। গণপরিবহনে বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক পরিবহনে অপ্রাপ্ত চালক-হেলপার যাত্রীদের জানমালের ঝুঁিক নিয়ে চলাচল করে। বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ এসব দেখেও চোখবুজে থাকে। সড়কে গণপরিবহনের ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। ছোট ছোট গণপরিবহন গাড়ির বৈধ কাগজপত্র ছাড়া রাস্তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পরিবহন চলাচল করছে। প্রতিদিন শত শত পরিবহন রাস্তায় নেমে পড়ছে। নতুন-পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় পরিবহনে সড়ক শৃঙ্খলা খোঁজে পায় না। ফুটপাত পর্যন্ত পরিবহনের কারণে চলাচল অযোগ্য হয়ে যায়। ফুটপাতের যাত্রী শঙ্কার মধ্যে পথ চলে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা চরমভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হয়। বলতে গেলে একটা উচ্ছৃঙ্খল এবং বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ পরিবহন সেক্টর।

এ সেক্টরের শৃঙ্খলা আনতে হলে প্রথমে শৃঙ্খলায় আসতে হবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে। তারপর আসতে হবে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগকে। এরপর সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিককে। এসব সংস্থা কর্তৃপক্ষ যত দিন না সমন্বয়, আন্তরিক, দুর্নীতিমুক্ত হবে না; ততক্ষণ পর্যন্ত এ সেক্টরকে দুর্ঘটনামুক্ত করা যাবে না। পরিবহন শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার তাদের প্রয়োজনীয় দাবি-দাওয়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে। দেখা যায়, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন পরিবহনের ওপর নির্দিষ্ট আকারে দৈনিক টাকা বসিয়ে দেয়। ফলে সড়কে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী ওঠানামা করতে যুদ্ধে নেমে পড়ে। ওভারটেকিং, অবৈধ লাইসেন্স প্রদান, অপ্রাপ্তদের হাতে পরিবহন তুলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষগুলোকে সমাজে স্বসম্মানে বেঁেচ থাকার নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের প্রতি যাত্রীসাধারণের ব্যবহারেরও পরিবর্তন হতে হবে। তারা সমাজের অংশ, তাদের শ্রম ছাড়া সড়ক অযোগ্য। সেসব বিষয় চিন্তায় রেখে পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটা শৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থানে আসতে হবে। তাদের ন্যূনতম শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, রাস্তার সবগুলো শৃঙ্খলা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেওয়া দরকার। পরিবহন মালিকদের রাস্তায় গাড়ি নামানোর পূূর্বে শ্রমিকদের যোগ্যতা দেখা উচিত। অর্থের জন্য জীবনের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এভাবে অযোগ্য, অপ্রাপ্ত লোকদের হাতে পরিবহন তুলে দেওয়া মারাত্মক ধরনের অপরাধ। তাই সড়কের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রথমত. বিআরটিএ পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও ট্রাফিক পুলিশকে সব ধরনের অনৈতিক লেনদেনের ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। এসব সেক্টর থেকে সব ধরনের ঘুষ দুর্নীতি দালাল চক্র প্রতিহত করতে হবে। সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রণালয়কে সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাস্তব জায়গায় হাত দিয়ে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কখনো হাজার লেখালেখী হলেও ওইসব কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে না। সরকারের বিআরটিএর মতো সেবা সংস্থাগুলোকে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা দালাল চক্রের বিরুদ্ধে মাদক ও জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার মতো অভিযান চালাতে হবে। তাদের বৈধ-অবৈধ অর্থের হিসেব নিতে হবে এবং রাষ্ট্রের কোষাগারে এসব অর্থ জমা দিতে হবে। লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তক এবং পত্রিকাসমূহ এসব বিষয় তথ্যসহ লিখেই যাবে অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না রাষ্ট্র সেটা সড়কে শৃঙ্খলার জন্য জঘন্য অপরাধ। বেসামাল পরিবহন এ খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে অবিলম্বে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও যাত্রী কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মতো সামাজিক সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দৃশ্যমান তৎপরতাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close