এস এম নাজের হোসাইন

  ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

মতামত

গ্রাহক স্বার্থ বনাম ব্যাংক ও এনজিও

সাম্প্রতিককালের অন্যতম আলোচিত বিষয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কয়েকবার বলার পরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সুদের হার এক ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারেনি। পরে অবশ্য সরকারের কয়েক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে প্রথমে সরকারি ব্যাংক ও পরে বেসরকারি ব্যাংকগুলো নামিয়ে আনার ঘোষণা দিলেও ব্যাংকের গ্রাহকদের বক্তব্য হলো, এখানে এখনো অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সুদের হার এক ডিজিটে নামাতে নানা গড়িমসি করছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও বেসরকারি ব্যাংক মালিকরা সুদের হার নামাতে গড়িমসি করলে সরকার তাদের নানা সুবিধা দেয়। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে হোটেলে ডেকে নিয়ে মিটিংয়ে বসার দুঃসাহস পর্যন্ত তারা দেখিয়েছে। তবে অনেকেই বলে থাকেন, বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ।

অতিসম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি বেশ আলোচনার ঝড় তুলেছে। তা হলো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের কিস্তি দিতে দিতে একজন গ্রাহকের সর্বশেষ শার্ট-প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই থাকছে না। বিষয়টি কাল্পনিক মনে হলেও সত্যিকারের কাহিনি কিন্তু এটা। যারাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের দ্বারস্থ হয়েছেন, তাদের অধিকাংশের বেলায় এ দৃশ্যটি ফুটে উঠেছে। এনজিওগুলো গ্রামগঞ্জে গরিবদের ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে থাকে, ঋণের বিপরীতে কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই। যারা এক হাজার টাকায় এক বছরে ১৫ শতাংশ হারে ঋণ প্রদান করছে, তখন আমাদের নাগরিক সমাজের একটি অংশ তাদের সুদখোর বলে গালি দেওয়া শুরু করে। পরে সেখানে আমাদের নীতিনির্ধারকরাও সেটা বলা শুরু করলেন। কিন্তু একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন কাউকে ঋণ দেন, তখন তার সব সহায়-সম্বল ঋণের বিপরীতে জামানত বা বন্ধকী রেখে ঋণ দেন। আর ঋণের সুদ যাই হোক না কেন, ঋণ আদায় প্রক্রিয়াটি ভয়াবহ; যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। যেমন আপনি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিলেন ১৫ বছরের জন্য। যদি আপনার মাসিক কিস্তি হবে ২৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর ১৫ বছরের প্রথম ১০ বছর আপনার ঋণের কোনো আসল পরিশোধ হবে না, ১০ বছর পর এসে আপনার আসল পরিশোধ হওয়া শুরু হবে। আর এনজিও ঋণের বেলায় ১ হাজার ঋণের বিপরীতে প্রতি সপ্তাহে ২৩ টাকা পরিশোধ করতে হলে আসল পরিশোধ হবে ২০ টাকা আর সুদ ৩ টাকা। তার অর্থ এই নয় যে, আমি এনজিওদের পক্ষে ওকালতি করছি। বিষয়টির অবতারণা করছি মাত্র। আমাদের দেশে বড় মাপের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে কথা বলা লোকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। সাবেক সফল গর্ভনর ড. আতিউর রহমান কিছু সংস্কার শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে মধ্যখানে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন।

ব্যাংকের প্রচলিত ঋনের সুদ নির্ধারণ ও কিস্তি আদায়ের প্রক্রিয়াটির বিষয়ে অনেকে বলবেন এটি পুরো বিশ্বজুড়ে সুদ নির্ধারণ প্রক্রিয়া, সে কারণে বাংলাদেশে এটা পরিবর্তন সম্ভব নয়। সেখানে আমি বলতে চাই, দরিদ্র মানুষকে জামানতবিহীন ঋণ দিয়েও তা সফলভাবে আদায় বাংলাদেশ দেখিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ এখন পৃথিবীর বিভিন্নœ দেশে সফল দারিদ্র্যবিমোচনের মডেল। সে কারণে প্রচলিত ব্যাংকঋণের সুদ নির্ধারণ ও আদায় প্রক্রিয়াটিও পরিবর্তন বাংলাদেশ থেকে শুরু হতে পারে। এখানে প্রচলিত ব্যাংকের ঋণের দুটি গল্প উপস্থাপন করতে চাই। দেশে একজন ব্যাংকের গ্রাহক, যিনি একটি শপিং মলে জুতার দোকান করেন, ব্যবসার প্রয়োজনে ঋণ নিলেন মাত্র ১৫ লাখ টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থাপক প্রথমে ওডি হিসেবে ঋণ দিলেন, পরে তা পরিবর্তন করে এসএমই ঋণে তা পরিবর্তন করে দেন। ওই গ্রাহক তিন বছর প্রতি মাসে মাসে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে ১৬ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর যখন পুরো ঋণটি শেষ করতে চাইলেন, তখন ব্যাংক আরো ১৫ লাখ টাকা দাবি করল। একপর্যায়ে বিষয়টি ফয়সালা করতে না পেরে ক্যাবের কার্যালয়ে অভিযোগ জানালেস, ক্যাব বিষয়টি নিয়ে প্রথমে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির মধ্যস্থতায় মীমাংসা করার উদ্যোগ নেয়। স্থানীয় ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক ওই গ্রাহকের নামে পাঁচটি মামলা টুকে দেন। ঋণ নেওয়ার সময় জামানত হিসেবে তার জমি বন্ধকী রাখা হয় এবং তারিখবিহীন খালি চেক জামানত নেওয়া হয়; যা দিয়ে আদালতে মামলা রজু করা হয়। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় আদালত কোনো ধরনের বিচার বিশ্লেষণ না করে আসামির বিরুদ্ধে পাওনা টাকা আদায়ে সমন নোটিস ইস্যু করেন। একপর্যায়ে ক্যাব এবং ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে মাত্র আট লাখ টাকায় বিষয়টি মীমংসা হয়। গ্রাহক তার বন্ধকীকৃত জমি ও খালি চেকগুলো ফেরত পান এবং ঋণ থেকে মুক্তি পান।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী ২০১০ সালে এইচএসসিসি ব্যাংক থেকে ১৫ বছর মেয়াদি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট কিনলেন। চুক্তি ছিল ৯ দশমকি ৯৯ শতাংশ হারে সুদ নিবে। সেই হিসেবে মাসিক কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৫০০ টাকার মতো। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে সুদের হার বেড়ে গেল পর্যায়ক্রমে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত এবং মাসিক কিস্তি গিয়ে ঠেকল ৩৪ হাজার টাকায়। তার পরিকল্পনা ছিল পাঁচ বছর পরে এক কালিন বাকি টাকা নগদ পরিশোধ করে ঋণ মুক্ত হবে। যথারীতি পাঁচ বছর পরে ব্যাংকে গিয়ে বকেয়ার হিসাব নিতে গিয়ে দেখেন ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা বকেয়া আছে। ভদ্রলোক অবাক! এটা কীভাবে হয়? কারণ তিনি ইতোমধ্যে ২২ লাখ টাকা পরিশোধ করে ফেলেছেন। কারণ জিজ্ঞেস করায় ব্যাংক বলল, ‘১৫ বছরের ঋণের সুদ অগ্রিম হিসাব করে মাসিক কিস্তির সঙ্গে ৯৫ শতাংশ হারে কেটে নেওয়া হচ্ছে এবং গৃহঋণের এটাই নিয়ম।’ অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে ঋণের আসল কাটা গেছে মাত্র ৫ শতাংশ হারে। এটা যেন মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। পরে সে নিজের বোকামি বুঝতে পেরে সিদ্ধান্ত নিলাম আর এই ফাঁদে পা দিব না, অন্যত্র অনেক মূল্যবান প্রপার্টি বিক্রি করে ব্যাংকের বকেয়া টাকা এককালীন পরিশোধ করলেন।

এখানে এখন প্রশ্ন হলো, সুদখোর বলে যাদের আমরা প্রতিনিয়ত গালি দিচ্ছি, সে এনজিওগুলো ঋণের কিস্তি আদায়কালে মূল টাকার সঙ্গে ঋণের সুদের সমন্বয় করলেও ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানিগুলো আগে পুরো সুদ আদায় করে নিয়ে ৫ থেকে ১০ বছর ঋণের কিস্তি দেওয়ার পর ক্রমান্বয়ে মূল টাকা সমন্বয় করে থাকেন। যার কারণে একজন ঋণী গ্রাহক ব্যাংকের ঋণের টাকা দিতে দিতে ফতুর হয়ে যান। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কর্মচারীরা দিনে দিনে এয়ারকন্ডিশন বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করে থাকেন। ব্যাংক মালিকরা প্রতিনিয়ত একের পর আর একটি ব্যাংক খুলছেন আর যারা এর জোগান দেন সেই ঋণী গ্রাহকরা দিনে দিনে ফতুর হয়ে যাচ্ছেন। এনজিওগুলো আরো একটি কাজ করে থাকেন, তা হলো কোনো কারণে কোনো ঋণী গ্রাহক ব্যবসায় লোকসান দিলে তারা তাকে বর্ধিত ঋণ দিয়ে তার ব্যবসাটি পুনরায় চালু করতে সহায়তা করেন এবং ঋণী কোনো কারণে মারা গেলে তার ঋণটি বীমা থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ঋণ গ্রাহকের যাবতীয় ঋণ মওকুপ করেন। ব্যাংকের বেলায় ঋণী গ্রাহক মারা গেলে তার পরিবার পরিজনকে সে টাকা পরিশোধ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হলেও গ্রাহক হয়রানি, অনিয়ম নিয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে সক্ষম হয় না। বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও কোনো কোনো সময় আমলে না নিয়ে সরকারের শীর্ষমহলের কাছে দেনদরবার করে থাকে। ফলে একজন সাধারণ গ্রাহকের আহাজারি ও কান্না তাদের কানে যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম, গ্রাহক হয়রানি এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে; যার খেসারত দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। ব্যাংক লুটপাট, ঋণ প্রদানে অনিয়মসহ নানা রোগে ব্যাংকগুলো যেমন আক্রান্ত, তেমনি ঋণ প্রদানে উচ্চসুদ, আবার গ্রাহকের টাকায় ব্যাংকের পকেট ভারী করলেও লাভের পরিমাণ খুবই নগণ্য। যারা ব্যাংকের মালিক তারা যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছে, তার দশ গুণ তুলে নিচ্ছেন নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে। আর্থিক খাতের এই দৈন্যদশা জাতির অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে দিবে। আর অবস্থার পরিত্রাণ পেতে হলে প্রথমেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ ব্যাংকের গ্রাহক আছে বলে আজকে অনেকেই ব্যাংকের মালিক, কর্মকর্তা ও কর্মকর্তা। তাই গ্রাহকের স্বার্থসংরক্ষণ ও মর্যদা প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close