শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২০ জানুয়ারি, ২০১৮

রোহিঙ্গা

প্রত্যাবাসনে ঐক্য অনৈক্য

অনেকদিন পরে হলেও মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। যার কারণ হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের হত্যাযজ্ঞ যেমন থেমেছে, তেমনি সু চির সরকার এর দায়ও স্বীকার করেছে। আর আমরা সৌভাগ্যবান যে, মানবতাকে ভুলুণ্ঠিত করিনি, বিশ্বের কাছে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আজ ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন বাকি কাজ হচ্ছে, দ্রুত নিরাপদে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া। এ দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশ সরকারের নয়, সু চির সরকারেরও।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয় দেশের রাজনৈতিক দল থেকে অনেক বিরূপ মন্তব্যও শোনা গিয়েছিল। সবশেষে আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য চূড়ান্ত করে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ। এ বিষয়টি সত্যিকার অর্থে একটি সুসংবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের দীর্ঘ বৈঠকে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর দুই পক্ষ এতে স্বাক্ষর করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সম্মতিপত্র এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের দলিলের (টার্মস অব রেফারেন্স) ভিত্তিতে সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের ৫৪ দিনের মাথায় ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চূড়ান্ত হলো। ১৯৯২-৯৩ সালের চুক্তিকে ভিত্তি করে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে এ চুক্তি সংকট পুরোপুরি কাটাতে খুব একটা সহায়ক হবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে পোপ যখন ভ্যাটিকান থেকে উভয় দেশ সফরে আসেন, তার প্রাক্কালে তাড়াহুড়া করে এ রকম চুক্তিকে অগোছালো কূটনীতির পরিচায়ক বলেও উল্লেখ করেছিলেন তারা। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়াটাই মূল কথা।

জানা যায়, রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের জন্য একটি ফরমও চূড়ান্ত করা হয়েছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে। প্রতিটি পরিবারকে একটি ইউনিট ধরে পরিচয় যাচাই ও প্রত্যাবাসনের কাজটি হবে। অনাথ ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় জন্ম নেওয়া শিশুদের প্রত্যাবাসনের বিষয়েও বলা হয়েছে চুক্তিতে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে যে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে, তাদের দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারেÑএমন আভাসও মিলেছে। চুক্তি অনুযায়ী, সীমান্তে পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প খুলবে বাংলাদেশ। সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা হবে মিয়ানমারের দুটি ক্যাম্পে। সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে হ্লা পো কুংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটামাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুর্নির্মাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার। মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের বাসিন্দাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করারও ব্যবস্থা নেবে দেশটি।

আগে বলা হয়েছিল, সরকার কর্তৃক প্রদানকৃত নিজেদের পরিচয়পত্র যারা দেখাতে পারবে তাদের গ্রহণ করবে দেশটি। এর মধ্যে থাকবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ‘সাদা কার্ড’ কিংবা ‘সাদা কার্ড’ জমা দেওয়ার রসিদ। কিন্তু এ পদ্ধতি কতটা সফলভাবে কাজ করবে, এ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। মিয়ানমার প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভালো করেই জানেন, অনেক রোহিঙ্গাই এসব শর্ত পূরণ করতে পারবে না। কারণ তাদের অনেকের কাছেই পরিচয়পত্র কিংবা প্রমাণপত্র নেই। আবার অনেকে হয়তো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো অল্প কিছুসংখ্যকের কাছে থাকতে পারে। পরিচয়পত্র ছাড়াও প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গারা তাদের নাম, পরিবারের সদস্যদের নাম, মিয়ানমারে কোথায় বাস করত সেখানকার ঠিকানা, জন্মতারিখ ও ফিরে যাওয়ার স্টেটমেন্ট দিতে হবে। আমরা মনে করি, চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার যাতে তাদের নাগরিকদের মর্যাদার সঙ্গে দ্রুত ফিরিয়ে নেয়, সে ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখাও জরুরি।

রোহিঙ্গাবিষয়ক তথ্যাদি সতর্ক হয়ে পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গা মুসলিমদের টার্গেট করে চালানো সহিংসতা জাতিগত নিধন বৈ কিছু নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণকে সমর্থন করেছিলেন। বলা যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দুই দেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষর হয়।

এদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানা যায়, সম্প্রতি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের দায় স্বীকার করেছেন সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান সু চি ও সেনাপ্রধান মিন অং লেইং। তাদের দায় স্বীকার করায় এটি ইতিবাচক হিসেবে বিশ্লেষকরা গ্রহণ করেছেন। ফেসবুক পাতায় এক পোস্টে সু চি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য এ এক নতুন ধাপ। আমি বিষয়টিকে এভাবেই দেখি। কারণ দেশে আইনের শাসনের জন্য একটি দেশের দায় নেওয়াটা জরুরি। আর সেই দায় নেওয়ার পথে এটিই হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ। এটি একটি ইতিবাচক ব্যাপার।’ দায় স্বীকার ও চুক্তির পরও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমন থেমে নেই। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, দায়সারা প্রত্যাবাসন চুক্তিকে মিয়ানমারের সেনারা মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেশটির সেনাদের নির্যাতন অব্যাহত থাকায় পালিয়ে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রত্যাবাসন চুক্তির পর ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ না হলে চুক্তি অনুযায়ী একদিকে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত গেলেও তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, ফিরে গিয়ে কতটা স্বস্তিতে থাকতে পারবেÑএ ব্যাপারেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে আশ্রিত অনেক রোহিঙ্গা। তারা ফিরে গিয়ে যাতে মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করাও জরুরি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সব পক্ষের দায়িত্ব পালন করা উচিত। এ বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এটাই স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত না থাকলে দেশটি নানা কৌশলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করবে, যা কোনোমতে গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা বলতে চাই, প্রত্যাবাসন চুক্তির পরও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমার নানাভাবেই রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে স্বীকৃতি না দিয়ে বাঙালি হিসেবে দেখছে। বিষয়টিরও মীমাংসা হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি। আবার রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেলে তাদের সহায়তার পরিবর্তে সামরিক বাহিনী পদে পদে বাধা দিতে পারে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মাত্রায় সহিংসতা ও বর্বরতার অভিযোগ রয়েছে, সেখানে এ ধারণা অমূলক নয়। সর্বোপরি প্রত্যাশা করব, চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ‘নিরাপদ’ হোক। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সে দেশে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist