শহিদুল ইসলাম, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
কুয়াকাটার ফয়েজ মিয়ার নারকেল বাগান
স্মৃতি আর রূপকথা
বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সেখানে বিলীন হয়ে গেছে প্রাকৃতিক বেষ্টনী ফয়েজ মিয়ার নারকেল বাগান। ঢেউয়ের ঝাপটায় অব্যাহত বালু ক্ষয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩৩ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত এখন ল-ভ-। গত ১০ বছরে লতাচাপলী মৌজার অন্তত ২০টি জমির সিটের ১০ হাজার একর সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সৈকতের কোল ঘেঁষে ছিল প্রকৃতিপ্রেমী ফয়েজ মিয়ার নারিকেল বাগান। আজ থেকে ১০ বছর আগেও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে ছিল একটি শালবাগান। পুব পাশের প্রায় ২০০ একর জমিতে ছিল বাগানটি। গত বছরের বর্ষা মৌসুমে ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাগানের একটি ক্ষুদ্র অংশ টিকেছিল। কিন্তু এ বছরের শুরুতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে ফয়েজ মিয়ার সেই শখের নারিকেল বাগান।
বাগানটির নাম ছিল কুয়াকাটা ফার্মস এন্ড ফার্মস। সেখানে সারি সারি নারিকেল গাছ থাকায় সকলের কাছে ‘নারিকেল বাগান’ হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে। দেশের বেসরকারি উদ্যোগে সৃষ্ট দ্বিতীয় বৃহত্তম বাগান এটি। সুশীতল দক্ষিণা সাগরের বাতাস পর্যটকদের মনে এনে দিত অন্যরকম প্রশান্তি। গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাগানটি আজ শুধুই স্মৃতি। কিছু মানুষের লোলুপ দৃষ্টি আর সমুদ্রের করালগ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে বাগানটি। গত বছর বর্ষার শেষ মৌসুমে বেশ কিছু নারিকেল গাছ মূলের মাটি হারিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চলতি মৌসুমে তা আর টিকে থাকতে পারেনি। কালের স্বাক্ষর বহনকারী এ গাছগুলো স্মৃতির পাতায় চলে গেছে।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা ১৯৭ একর সরকারি বনভূমি লিজ নিয়ে বাগানটি করেছিলেন ফয়েজ মিয়া। নারিকেল গাছ ছাড়াও তিনি রোপণ করেছিলেন পেয়ারা, কাজু বাদাম, লেবু, কুল, গর্জন, সুপারীসহ বিভিন্ন জাতের ফলদ ও ঔষধি গাছ। সকাল-সন্ধ্যা নানা প্রজাতির পাখির কলরবে মুখরিত থাকত। গহিন বাগানে থাকত শুকর, চিতাবাঘ, অজগর, সজারু, খরখোশসহ বন্যপ্রাণী। গাছে গাছে বানর ও বাদুরের দাপাদাপি, শেয়ালের ডাক শোনা যেত দুই দশক আগেও। পুরোনো মানুষের কাছে এগুলো কেবলি স্মৃতি, বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপ কথার গল্প হয়ে গেছে।
ফার্মস এন্ড ফার্মস’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেখা তারিকের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। রেখা ফয়েজ মিয়ার পুত্রবধূ। তিনি জানান, তার শ্বশুর সরকারি জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে সখের বাগানটি করেছিলেন। সেই সময় সরকারি কোষাগারে ৬৫ হাজার টাকা রাজস্বও দিয়েছেন। বন জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান উপযোগী করতে ৮০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। বিভিন্ন জাতের গাছ লাগাতে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এ জন্য বরিশাল শহরের পাঁচ একর জমি বিক্রি করতে হয়েছিল তাকে। তিনি মারা গেলে তার (রেখা তারিক) স্বামী মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তারিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব করেছেন।
রেখা তারিক আরো বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে বাগানটি হাত বদলের চেষ্টায় লিপ্ত হয় একটি প্রভাবশালী মহল। ২০০৭ সালে আমরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করি। মামলা চলমান অবস্থায় ২০০৯ সালে আমার স্বামী আবু তারিক মারা যান। আমি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে মামলা পরিচালনা করি। সর্বশেষ হাইকোর্ট থেকে রায় আসে আমাদের পক্ষে। আমি বাগানটি বুঝে পেতে রায়ের কপি নিয়ে জেলা প্রশাসকের দ্বারস্থ হই। জেলা প্রশাসক উল্টো আপিল করেন। আপিল মামলা এখনো চলমান আছে, কিন্তু বাগান তো আর নাই।’
মহিপুর ভূমি কর্মকর্তারা জানান, মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেনি ‘ফার্মস এন্ড ফার্মস’ কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া ১৯৬০ সালে প্রায় ২০০ একর জমি লিজ দেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। এ জন্যই সরকারি জমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো মামলা চলমান আছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত ২০ বছর ধরে অব্যাহত বালুক্ষয় হচ্ছে। এটা রোধের চেষ্টা করেনি কোনো সরকার। এ কারণে ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হতে থাকে বাগানটি। পাল্টে গেছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চিত্র। মুছে গেছে ফয়েজ মিয়ার বাগানের নাম নিশানা।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, বালুর সৈকতের বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল। অনেক গাছ রাতের আঁধারে কেটে নিয়ে গেছে স্থানীয়রা। এখনো অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে আছে। ফলে জোয়ারের সময় দর্শনার্থীদের সমুদ্রস্নানে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য ‘সী বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ নামে একটি সংগঠন আছে, তবে তাদের কোনো কাজ চোখে পড়ে না।
কুয়াকাটার এক প্রবীণ ব্যক্তি চান মিয়া হাওলাদার বলেন, পটুয়াখালী জেলার বাউফল থেকে এসে ১৯৬৪ সালে ফয়েজ মিয়া কুয়াকাটা সৈকতে বাগান সৃজন শুরু করেন। বাগানে বাঘ, বানর, শিয়াল, শুকর, সাপ, গুইসাপ, সজারু ছিল।
কুয়াকাটা ফার্মস এন্ড ফার্মস’র জন্মলগ্ন থেকে ফয়েজ মিয়ার হাত ধরে কাজে যোগদান করেন আ. রশিদ মিয়া। তিনি স্মৃতিকাতর হয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মোর জীবন তো এই বাগানেই শ্যাষ অইয়া গেছে। ১২ বছর বয়সে ফয়েজ মিয়ার লগে কামে আইছিলাম। এ্যাহন মোর বয়স ৭০ বছর। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন সরকারের আমলে বাগান দিয়া আমাগো বাইর কইর্যা দেয়। এই শ্যাষ অইয়া গেল বাগানডা।’
স্মৃতিচারণে ওই ফার্মের কেয়ার টেকার বেলায়েত সরদার জানান, লবণাক্ত মাটিতে যেসব গাছ জন্মে তার সবটাই ফয়েজ মিয়া লাগিয়েছিলেন। তিনি বিএনপি সরকার আমলের (২০০৫) এক প্রভাবশালী এক নেতাকে দোষারোপ করে বলেন, ‘বাগানডা ওনার মাইয়ার নামে নেতে চাইছিল, পারে নাই। ওনার কারণে বাগানডাও আইজ নাই আর কুয়াকাটা সাগরপাড়ও শ্যাষ অইয়া গেছে।’
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক ড. মাছুমুর রহমান জানান, লিজ যথাযথভাবে না নেওয়া এবং আইনি জটিলতা থাকায় সরকার পুনরায় দখলে নিয়েছে। তাছাড়া বালুক্ষয়ে বাগানটি ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। তবে সৈকতের বালু ক্ষয়রোধে সরকার ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে।
"