রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৮ মার্চ, ২০২০

বিশ্বজুড়ে সম্পদের বৈষম্য বাড়ছেই

বিশ্বায়নের হাত ধরে গত দেড় দশকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছে অগণিত মানুষ। প্রায় সব প্রান্তে বাড়ছে প্রতিবাদ। কোথাও ট্রেনের টিকিটের দাম তো, কোথাও তেলের চড়া দর বিভিন্ন কারণে বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নেমে আসছে সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ বাড়ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতেও। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকেই এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানব উন্নয়নসূচক হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স।

একসময় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ইউনিয়ন বা কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে কনফেডারেশন গঠনের আগ্রহ ছিল। কিন্তু এটি পরবর্তী সময় কেবলই কার্যকারিতা, গুরুত্ব এবং জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। অনেক কনফেডারেশন ও রাজনৈতিক ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। ভাঙনের এ রকম ঘটনা শুরু হয়েছে বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই।

১৯৪৫ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে সব মিলিয়ে ডজনখানেক ফেডারেশন গঠনের চেষ্টা করা হয় এবং তার মধ্যে কয়েকটি গঠিতও হয়েছে। ফেডারেশন গঠনের তৎকালীন এই প্রবণতাকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মাইকেল কলিন্স নাম দিয়েছেন ফেডারেল মোমেন্ট। সদ্য উপনিবেশমুক্ত দেশের অনেকেই মিলে ওই সময় বহু দেশীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশন, সেন্টাল আফ্রিকান ফেডারেশন, ইস্ট আফ্রিকান ফেডারেশন, ফেডারেশন অব মালয়েশিয়া এবং ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক। এই ফেডারেশনগুলোর মধ্যে কোনোটিই এখন আর নেই। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা ও জনগণের মনের বিষয়টি নিয়েও ভাবতে শুরু করেন অনেক আগেই। একসময় তারা ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা শুরু করে। অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি না, এই প্রশ্নে ২০১৬ সালে নিজ দেশে গণভোটের আয়োজন করেন। সেই গণভোটে ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। সেই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া এই বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করেছে। বের হওয়ার এই প্রক্রিয়া এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। এ সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কী হবে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তা নিয়ে আলোচনা করবে। আর এই ক্রান্তিকালীন সময়ে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাস্টমস ইউনিয়ন এবং অভিন্ন বাজারের আওতায় থাকবে।

কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক সদস্য হিসেবে আর থাকবে না। ব্রিটিশ মূল্যবোধ, ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমান্তরাল আরেকটি সমাজ তৈরি করছে ভিন্ন সমাজব্যবস্থা থেকে আসা এই মানুষগুলো। তাদের এত দিন ধরে ভোগ করে আসা মৌলিক অধিকারে ভাগ বসাচ্ছে এসব অভিবাসী। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়ে ব্রিটেন তার স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। বেশির ভাগ ব্রিটিশ এমন মানসিক ও সামাজিক সংকটে ভুগছে। এ সংকট জাতীয়তাবাদের, অধিকারের এবং সার্বভৌমত্বের এবং আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের। তাই নিজেদের নিপীড়িত ভাবছেন অনেক ব্রিটিশ। হালের ব্রেক্সিটের সঙ্গে এই ফেডারেশনগুলোর ব্যর্থতার একটি মিল পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে প্রায় সবগুলোতেই সাধারণ জনগণ এ ধরনের সংহতিকে মেনে নিতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে সংকীর্ণচিত্ততা এবং নিজ পরিচয় বড় করে দেখার কারণে সৃষ্ট বিভেদ যে রকম ফেডারেশনগুলোকে দুর্বল করেছে, সেই একই কারণ ব্রেক্সিটকেও প্রভাবিত করেছে। তাই ব্রেক্সিটকে ধরা হচ্ছে জনপ্রিয়তাবাদী জাতীয়তাবাদের পক্ষে সাধারণ জনগণের রায় হিসেবে। গত দুই দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তাবাদী জাতীয়তাবাদ ক্রমশ সমর্থন ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ইউরোপীয়দের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি লোক তাদের শেষ নির্বাচনে পপুলিস্টকে ভোট দিয়েছে। বর্তমানে ১১টি ইউরোপীয় দেশের সরকারে পপুলিস্ট দল ক্ষমতায় আছে। আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় ও একই ঘটনার জানান দিচ্ছে।

ব্রিটিশ নির্বাচনে বরিস জনসনের জয়লাভের অন্যতম একটি কারণ তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিলেন। এমনকি ভারতে বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়লাভ ও জনপ্রিয়তাবাদী জাতীয়তাবাদের জনপ্রিয়তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। মূলত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন জয় ও ইউরোপে উগ্র ডানপন্থি দলগুলোর উত্থানের পর থেকেই ‘পপুলিজম’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছে। এই তথাকথিত পপনাটরা জাতীয় সার্বভৌমত্বের পক্ষের ধারণার সমর্থক বলে দাবি করে থাকেন। তারা অভিবাসনের ধারণার বিরুদ্ধে এবং ইতিহাসভিত্তিক জাতীয় বিশুদ্ধতায় বিশ্বাসী। তাদের বেশির ভাগেরই একটি অসাধারণ, কর্তৃত্ববাদী ধারা এবং যেকোনো মূল্যে জয়লাভ করার মানসিকতা রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির লেকচারার বেঞ্জামিন মফিট ‘দ্য গ্লোবাল রাইজ অব পপুলিজম’ নামে একটি বই লিখেছেন। তার মতে, গড়পড়তা একজন পপুলিস্ট নেতার আরো অনেক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন তাদের আচার-আচরণ খুব সুবিধার থাকে না। গড়পড়তা রাজনীতিকের মতো তারা আচরণ করেন না। রাজনৈতিক সুলভ আচরণ না করার কৌশল প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে। পপুলিস্ট নেতাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো সংকট কালীন সময়কে জিইয়ে রাখা। আর এ কারণেই বহু সংস্কৃতিবাদ, নব্য-উদারতাবাদ ও বিশ্বায়নের কারণে তৈরি বিভিন্ন সংকটকে পুঁজি করেই পপুলিস্ট দলগুলোর উত্থান ঘটছে। সাধারণত বলা হয় যে, যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে হয়, তখন পপুলিজমের আবেদন বাড়ে। এমনকি ফরাসি বিপ্লবের শুরুর পর্যায়ে জ্যাকোবিন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি আমেরিকায় নো-নাথিং মুসোলিনির ইতালিতে ফ্যাসিস্ট ও হিটলারের জার্মানিতে নাৎসিদের উত্থানের ব্যাপারগুলোকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন অনেকেই। এই পপুলিস্টদের আবেদনের প্রধান উপাদান হলো তীব্র জাতীয়তাবাদ এবং সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার নিয়ে কথাবার্তা। আরেকটি উপাদান হলো ইতিহাস বা অতীত নিয়ে এক ধরনের নস্টালজিয়া। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান আর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ও নেদারল্যান্ডসের পার্টি ফর ফ্রিডম দলের নেতা গির্ট ভিল্ডার্স খ্রিস্টীয় ইউরোপের ধারণা এর উদাহরণ। আবার ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারণার সময় ১৯৪০ সালের ডানকার্ক যুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল। এই যুদ্ধে জার্মান নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা একাই লড়েছিল। বিশ্বায়ন ও অটোমেশনের ফলে দেশগুলোতে চাকরি-বাকরি হারাচ্ছে অনেক মানুষ; প্রচুরসংখ্যক দেশে সম্পদের বৃহত্তর অংশ ভোগ করছে শক্তিশালী করপোরেশনগুলো আর ধনাঢ্যরা। দেখা যাচ্ছে, ধনীরা আরো ধনী হচ্ছেন আর গরিবরা হচ্ছেন আরো গরিব। পৃথিবীজুড়ে আয় ও সম্পদের বৈষম্য কেবল বাড়ছেই। অনেক মানুষের জীবনযাত্রার মান অব্যাহতভাবে খারাপ হচ্ছে। কিন্তু পপুলিস্ট নেতারা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সুবিবেচিত, বাস্তবসম্মত কোনো পথের কথা বলছেন না। তারা শুধু স্বপ্ন-কল্পনার প্রচার চালাচ্ছেন।

এ ছাড়া কয়লাখনোগুলো নতুন করে খুলে দেওয়া ও চীনের ওপর শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব, কোনোগুলোই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, এসব কারণে বাণিজ্যযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে, তখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। জনপ্রিয়তাবাদী জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটো দিকই আছে। ইতিহাসও তাই বলে। অতীতে আমরা দেখেছি, এটি কীভাবে বিভেদ তৈরি করে, যুদ্ধও বাধিয়ে দেয়। কখনো কখনো ফ্যাসিজমকেও উসকে দেয়, কখনোবা সন্ত্রাসবাদকে। আবার কখনো গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে করে ফেলে দুর্বল। অতীতে দেশগুলোর মধ্যে ফেডারেশন গঠনের আগ্রহের অনেকগুলো কারণ ছিল। সদ্য উপনিবেশমুক্ত অনেক দেশ নিজেদের অস্তিত্ব এবং অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার জন্য ফেডারেশনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল। বিশেষ করে ক্ষুদ্র, দরিদ্র এবং বিচ্ছিন্ন দেশগুলো। আর ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ফেডারেশন গঠনের প্রতি আগ্রহ ছিল, কারণ তারা ভেবেছিল ফেডারেশনের মাধ্যমে তারা তাদের ফেলে আসা উপনিবেশ দেশগুলোতে এক ধরনের প্রভাব জিইয়ে রাখতে সক্ষম হবে। কিন্তু তাদের কোনো ভাবনাই শেষ পর্যন্ত কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভ্রাতৃত্বের ঐক্যকে বিনষ্ট হচ্ছে অথবা বিনষ্ট করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে; যা ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য একটি অশনিসংকেত বলে মনে করছেন অনেকেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সম্পদ,বৈষম্য,বিশ্বায়ন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close