সাহাদাৎ রানা

  ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

অর্থনীতিতে ইলিশের ভূমিকা ও করণীয়

ইলিশ নিয়ে ভোজনপ্রেমী বাঙালির আগ্রহের শেষ নেই। আর সেই আগ্রহ দিন দিন বাড়ছেই। আগ্রহের পাশাপাশি বাড়ছে ইলিশের উৎপাদনও। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণÑ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, গত এক দশকে আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৫ শতাংশের বেশি। এমন বাড়ার চিত্র প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী। এখন আর ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়। ইলিশ এখন আমাদের অর্থনীতির একটি বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে ইলিশ এখন বিদেশে রফতানিও হচ্ছে। যার চাহিদাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ইলিশের এমন উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মা-ইলিশ যখন ডিম পারে; সেসময় তা না ধরার ক্ষেত্রে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। আর সেই নিষেধাজ্ঞা মেনে জেলেরা মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিরতি দেন। এর সুফলও আমরা এক দশক ধরে পাচ্ছি। তবে এবার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটছে ইলিশ ধরার সময় নির্ধারণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে।

সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও সরকার মা-ইলিশ শিকার বন্ধে গত ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে সারা দেশে ইলিশ মাছের আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ ছিল। জেলেরা যাতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে না পারেন; সেজন্য নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীকে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছর সশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য এ সময় যেন মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়। ঠিক এ সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণÑ ইলিশ প্রজননের ক্ষেত্রে মূলত চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। তাই ইলিশ গবেষকদের পরামর্শে প্রতি বছর আশ্বিন মাসের প্রথম উদিত চাঁদের পূর্ণিমার আগের চার দিন, পরের ১৭ দিন ও পূর্ণিমার দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এবারও সেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এত কিছুর পরও জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মানেননি। মৎস্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে অবাধে ইলিশ নিধন হয়েছে। বলা যায়, অন্যবারের চেয়ে এবার নিষেধাজ্ঞার সময়ে কিছুটা বেশি মা-ইলিশ মাছ ধরা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার সময়ে মা-ইলিশ ধরা একটা সমস্যা। আরো একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে কিছুটা পরে। অর্থাৎ সমস্যাটা দেখা দিয়েছে ৩০ অক্টোবরের পর থেকে। ৩১ অক্টোবর যখন ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়; তখন দেখা যায়, জেলেদের জালে অসংখ্যা ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়েছে। অবশ্য মৎস্য বিভাগের দাবি, ৮০ শতাংশ ইলিশই নির্ধারিত সময়ে ডিম ছেড়েছে। বিপরীতে মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলেছেন, নির্ধারিত সময়ে প্রায় ৬০ ভাগ ইলিশ এ সময়ের মধ্যে ডিম ছাড়তে পারেনি। যখন ছাড়ার সময় হয়েছে, তখনই জেলেরা মা-ইলিশ ধরেছে। এমন খবরের অর্থ হলো, মৎস্য বিভাগের ইলিশ গবেষণায় বা সিদ্ধান্তে ভুল ছিল। যে সময়ে ইলিশ ধরার জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, তা সঠিক ছিল না। তাই এ বছর ইলিশের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। অবশ্য মৎস্য বিভাগ অভিযোগ করেছে ৩১ অক্টোবরের পর যেসব মা-ইলিশ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, এগুলো অভিযানের আগে ধরা; যা ব্যবসায়ীরা এসব মাছ হিমাগারে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। এখন এগুলো বাজারে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তাহলে প্রশ্ন হলোÑ যদি এসব মা-ইলিশ অভিযানের আগে ধরা হয়, তাহলে অভিযানের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার হিসেবে ভুল ছিল। যেহেতু অভিযানের আগেই মা-ইলিশ ধরা পড়ছিল। তবে কেন মৎস্য বিভাগ মা-ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে তখন নিষেধাজ্ঞা দেয়নি বা সময়টা নির্ধারণ করতে পারেনি।

মৎস্য বিভাগ ইচ্ছভ করলে এ নিষেধাজ্ঞার সময় আরো ১০-১২ দিন বাড়াতে পারত। কেননা, এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া ও প্রকৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়া, বেশি তাপমাত্রার কারণে ইলিশের প্রজনন মৌসুমও পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই আগামীতে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়িয়ে ১৫ নভেম্বরের পর্যন্ত করা যেতে পারে। এতে মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাবে। নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়লে খুব একটা ক্ষতি নেই। বরং ক্ষতি মাছগুলোকে ডিম না ছাড়ার সুযোগ তৈরি করে দিলে। অবশ্য সময়ে সময়ে মা-ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বেড়েছে। দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল মা-ইলিশ না ধরার ক্ষেত্রে। এর এক বছর পর এই সময়সীমা আরো চার দিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ১৫ দিন নিষেধাজ্ঞা ছিল মা-ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে। আর ২০১৭ সালে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরো ৭ দিন বেড়ে যায়। সেসময় ১৫ দিনের জায়গায় করা হয় ২২ দিন। এগুলো সব করা হয়েছে আমাদের ইলিশ রক্ষায়। ধারাবাহিকভাবে যদি মা-ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়তে পারে, তবে আগামীতে কেন নয়। তাই আগামীতে ২২ দিনের পরিবর্তে ৩০ বা তার বেশি সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এতে বেশি করে মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পাবে। ফলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। লাভবান হবে দেশের অর্থনীতি।

কিন্তু এবার নিষেধাজ্ঞার পরও যেভাবে মা-ইলিশ ধরা পড়ছে তাতে সবাই শঙ্কিত। বিশেষ করে যখন আমরা ইলিশ ঘিরে আরো বড় স্বপ্ন দেখি। কারণ এখন আর ইলিশের অর্থনীতিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৭০ ভাগ আমাদের দেশে আহরণ করা হয়। যা ইলিশ আহরণের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশ প্রথম। আনন্দের খবর হলো, এই আহরণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অর্জনও কম নয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বড় একটি অর্জন। তাই ইলিশকে আমাদের আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

আমাদের দেশে বর্তমানে মোট মৎস্য উৎপাদনের ১২ ভাগই আসছে ইলিশ থেকে। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে রয়েছে আমাদের ইলিশের চাহিদা। এই চাহিদার কারণে প্রতি বছর ইলিশ রফতানি করে কয়েকশ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হচ্ছে। এখন যদি প্রজননক্ষম মা-ইলিশ ও

জাটকা ধরা বন্ধ রাখার বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যায়; তবে কয়েক হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। তাই এবারের শিক্ষা আগামীতে কাজে লাগাতে হবে। আগামী বছর থেকে ডিমওয়ালা মাছ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা অবশ্যই বাড়াতে হবে।

ইলিশকে কেন্দ্র করে কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে। যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইলিশ পরিবহন, বিক্রয়, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানির সঙ্গে জড়িত। নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে মৎস্যজীবী জেলে ও ইলিশ আহরণের পরিবহন ও বিপণনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবার মধ্যে আরো বেশি সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নসহ গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আরো ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশ আরো বড় ভূমিকা রাখবে। কারণ ইলিশ এখন শুধু একটি মাছ নয়, অর্থনীতির বড় ক্ষেত্রও।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মুক্তমত,অর্থনীতি,ইলিশ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close