রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

মানবিক সংকট বনাম বিশ্ব নেতৃত্ব

ইয়েমেন সংকট সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাসীর মনে দাগ কেটেছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এটি কেবল একটি যুদ্ধাহত দেশ নয়। বর্তমানে ইয়েমেন স্মরণকালের সর্বোচ্চ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায়ই দেখা যাচ্ছে না। যত দিন যাচ্ছে, ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানবসভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে। ক্ষমতা আর আধিপত্যের লোভে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে ইয়েমেন। আরব বিশ্বের সুন্দর এই দেশটিতে সৌদি আরব ও ইরানের ভূমিকা দেশটির হাজার হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করছে, যার অধিকাংশই রয়েছে নারী ও শিশু। যুদ্ধ, রোগ ও চরম দুর্ভিক্ষের কারণে দেশটির অধিকাংশ শিশু মরছে। আর জীবিতরা খাবার ও চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গৃহযুদ্ধের কারণে আজ পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার লড়াই দেশের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে আধুনিক সমাজে ইয়েমেন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

জাতিসংঘের মতে, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে ইয়েমেনে। দীর্ঘদিন ধরে দেশটিতে যুদ্ধাবস্থা চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় সেখানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে বহু বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, পানি শোধন কেন্দ্রসহ সব ধরনের সেবামূলক স্থাপনা। গত তিন বছরে সেখানে ২ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। যারা অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এ কারণেই কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। বলা বাহুল্য, এই বেসামরিক মানুষের বড় অংশই শিশু। সেখানে প্রতি ১২ মিনিটে মারা যাচ্ছে একটি শিশু। সে হিসাবে এক দিনে সেখানে ১২০টি শিশু মারা যাচ্ছে। এ ছাড়াও পাঁচ বছরের নিচের ৪ লাখ শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। সেখানকার শিশুরা জানে না তারা পরবর্তীতে কী খাবে অথবা তাদের সেই খাবার কোন উৎস থেকে সরবরাহ করা হবে। হাসপাতালগুলোতে অপুষ্টিতে ভোগা অসংখ্য শিশু মৃত্যুর প্রহর গুনছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধাবস্থার কারণে দেশটিতে চরম দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে। ভালো খাবার দূরে থাক, কোনোমতে সামান্য খাবার পেয়ে জীবন বাঁচানোটাই সেখানে আজ বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও দেশটিতে এখন আকাশছোঁয়া। তিন বছর আগে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের অনেক এলাকা দখল করে নিলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সমর্থিত সৌদি আরব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দেশটির সরকারের পক্ষ নিয়ে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তবে ইয়েমেনের এই সংকটকে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কৌশলগতভাবে ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ দেশটি বাব আল-মানডারের ওপর বসে আছে, যা রেড সি আর গালফ অব অ্যাডেনের সংযোগস্থল। এখান থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি দেশটিতে ভয়াবহ অর্থ তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাধারণত যা ঘটতে পারে, ইয়েমেনে সেটাই ঘটছে। এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য সৈদি আরবের রণনীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়েমেনে সৌদি আরব নিকৃষ্টতম কৌশল ব্যবহার করছে; যা বোমা মেরে বা স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়েও ভয়াবহ। সেটা হলো, সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অবরোধ। যার পরিণতিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ধ্বংসের অনুপাতে এর ব্যাপকতা ও স্থায়িত্ব অনেক বেশি। বলা চলে, যুদ্ধ আর অবরোধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ইয়েমেনের মানুষ।

ইয়েমেনের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে যুদ্ধ। এখানেও সেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। যে বিষয়টি বোঝার মতো বয়স নিষ্পাপ শিশুদের হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিশুরাই এ ধরনের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির সবচেয়ে খারাপ শিকার। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। যুদ্ধ শুধু ধ্বংস করতে পারে। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে সব জায়গাতেই রয়েছে পীড়িত মানুষের আর্তনাদ। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের খাদ্যের অধিকার রয়েছে। কেউ ক্ষুধার্ত থাকার কথাও নয়। এমনকি কোনো প্রাণীরও ক্ষুধার্ত থাকার কথা নয়। তবে যত কথাই বলা হোক না কেন, ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর আন্তরিকতার প্রয়োজন রয়েছে। ইয়েমেনের বর্তমান ভয়াবহ করুণ পরিস্থিতি বন্ধের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

এ মুহূর্তে বিশ্বমানবতার কাছে একটি বড় প্রশ্ন হলো, ইয়েমেনের সমস্যার কি সমাধান হবে? ইয়েমেনের অভ্যন্তরে যুদ্ধাবস্থা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, সেখানে মানবিক সংকট এখন চরমে। খাদ্য ও চিকিৎসাবিহীন মারাত্মক মানবিক সংকটে থাকা ইয়েমেনের হাজার হাজার শিশুর জীবনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় ইয়েমেন শতাব্দীর ভয়াবহতম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে ২০ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। জাতিসংঘ শিশু সংস্থা ইউনিসেফ সম্প্রতি এ খবর প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির একটি বিবৃতিতে বলা হয়, দুই বছর ধরে শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। এতে আরো ৩৭ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। ইয়েমেনে ইউনিসেফ প্রতিনিধি সারা বায়েসলো নয়ন্তি বলেন, ইয়েমেনে যুদ্ধের প্রভাবে ৮৫ হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে। গত বছর দুর্ভিক্ষের কবলে মারা যাওয়া শিশু আমালের মতো বহু শিশু দুর্ভিক্ষের কবলে রয়েছে ইয়েমেনে। যুদ্ধ যা যা করতে পারে, ইয়েমেনে তার সবই ঘটছে। অবস্থাকে চরম মানবিক সংকট বলা হচ্ছে।

ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের রাজধানী সানা দখলের পর অবরুদ্ধ সরকারের সমর্থনে সৌদি আরব ও তার মিত্র জোট ২০১৫ সালের মার্চ থেকে যে অভিযান চালিয়ে আসছে, তাতে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। এদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এ ছাড়া লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি দেশটিতে ভয়াবহ অর্থ তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাধারণত ঘটতে পারে, ইয়েমেনে সেটাই ঘটছে। এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য যুদ্ধের রণনীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। ইয়েমেনে যুদ্ধের নিকৃষ্টতম কৌশল ব্যবহার করছে, যা বোমা মেরে বা স্থাপনা উড়িয়ে দেওয়ার চেয়েও ভয়াবহ। সেটা হলো সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অবরোধ। যার পরিণতিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। ধ্বংসের অনুপাতে এর ব্যাপকতা ও স্থায়িত্ব অনেক বেশি। বলা চলে যুদ্ধ আর অবরোধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ইয়েমেনের সমাজ। এখনো আশপাশের বাজারগুলোতে খাবার জিনিস পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর দাম এত বেশি যে, অধিকাংশ বাবারই তার ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে জানলেই দেখা যায়, ফেলে যাওয়া কিছু ধ্বংসাত্মক অবস্থা ছাড়া আর কিছুই নেই। সে অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লেগেছে বহু বছর। কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধার চিৎকার আধুনিক অস্ত্রের শব্দের কাছে বড়ই মøান মনে হয়। ব্রিটিশ পত্রিকা ইনডিপেনডেন্টের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুদ্ধবিরতি না হলে মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ৩৩ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই হবে শিশু, যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে। সম্প্রতি জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইয়েমেনে প্রতি মিনিটে ১২টি শিশু মারা যাচ্ছে। যুদ্ধের চেয়ে সৌদি অবরোধের কারণেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে এই যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবু কোনো সুরাহা মিলছে না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট [email protected]

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
বিশ্ব নেতৃত্ব,মানবিক সংকট,কলাম,ইয়েমেন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close