গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৫ মার্চ, ২০২০

সুদৃঢ় অবস্থানে সরকার

দখলদারদের ভয়াল থাবা

সরকারি জমি, নদীর তীর, বন, পাহাড় সব কিছুই যাচ্ছে দখলদারদের করালগ্রাসে। বাদ যাচ্ছে না ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিও। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে অবৈধ দখলদারিত্বের কাজ। এরা এতটাই শক্তিশালী যে, চলমান উচ্ছেদ অভিযানকেও যেন তোয়াক্কা করছে না। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর ফের দলবল নিয়ে নেমে পড়েন। থমকে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানে দৃঢ় অবস্থানে মাঠে কাজ করছে সরকার।

টানা তৃতীয় দফা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে। দল ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তির নির্দেশনায় মৃত নদী রক্ষায় শুরু করেন উচ্ছেদ অভিযান। শুরুতে নানা সমালোচনার পাশাপাশি প্রশংসা কুড়ান। অনেকে বলেছিলেন, এ অভিযান বেশি দিন অব্যাহত রাখতে পারবেন না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু সরকারের এক বছর অতিবাহিত হলেও মন্ত্রণালয়টি অবৈধ উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে একাট্টা রয়েছে।

শুরুতে রাজধানীর চারপাশের প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ এবং শীতলক্ষ্যায় অভিযান চালায়। বাদ যায়নি নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর এলাকা। বুড়িগঙ্গার দুই পাশের অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা, তুরাগের বুকে গড়ে উঠা কয়েকশ’ অবৈধ স্থাপনা এবং শীতলক্ষ্যায় শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করেন তিনি। এরপরেও দখলদারদের প্রভাব কমেনি। অবৈধ স্থাপনার ওপরে ব্যক্তি-মালিকানাধীন শিল্প-প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদের স্থাপনা যেন প্রশাসনের নজরদারিতে নেই। কারণ শীতলক্ষ্যার তীরে বেআইনিভাবে গড়ে ওঠা শিল্প-প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালীরা থাকছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

অবৈধ দখলদারদের কালো থাবা থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরভূমি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি উদ্ধারে বাংলাফোন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমজাদ হোসেন টিএ-এর চেয়ারম্যান বরাবর গত মাসের শেষদিকে একটি আবেদন করেন। শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের আবেদন জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগটি আমলে নিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে টিএ, যা বর্তমানে বিবেচনাধীন। এ তালিকায় মেসার্স এমএসএম ব্রিকসের মালিক ফারুক, মোরশেদুল হক ভুঁইয়ার মেসার্স এমএমবি ব্রিকস এবং মো. জাহিদ হোসেন মোমেনের মেসার্স এইচআরবি ব্রিকস।

এর আগে বিআইডব্লিউটিএ শীতলক্ষ্যায় অভিযান চালিয়ে রূপগঞ্জের খৈসাইর এলাকার নদী দখল ও ভরাটের অভিযোগে সাব্বিরের মালিকানাধীন এএসবি ব্রিকস ফিল্ড, সিদ্দিকুর রহমানের মালিকানাধীন জিএসবি ব্রিকফিল্ড, হারিজুলের মালিকানাধীন এসএনআর ব্রিকফিল্ড, শরীফের মালিকানাধীন এমএনবি ১ ব্রিকফিল্ড, নাদিমের মালিকানাধীন এমএনবি২ ব্রিকফিল্ড, সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন বিআইপি ব্রিকফিল্ডের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও সেখানে থাকা ইট-বালু জব্দ করেছিল।

এছাড়াও সাকিল উদ্দিনের মালিকানাধীন এমকেবি ব্রিকফিল্ড, যুবলীগ নেতা এসটি সাত্তারের মালিকানাধীন এসটিএ কি ফিল্ড ও হ্যামকো ব্যাটারির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও জব্দকৃত মালামাল নিলামে বিক্রি করেছিল।

এদিকে গত ২ মার্চ দেশজুড়ে সব নদ-নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মধ্যে গত মঙ্গলবার তুরাগে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এ অভিযানে রাজধানীর একটি সংসদীয় আসনের প্রভাবশালী এমপির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ চালানোর পর গতকাল বুধবার তিনি দলবল নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে মাঠে নেমে পড়েন।

এদিকে দখলদারদের বিষাক্ত থাবায় ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে নদ-নদী ও খাল। ৫৩টি জেলার ২৩০টি নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজার ৭৬২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এদের উচ্ছেদ করার পরও ফের দখলের ঘটনা ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছে হাতবদল। দখলদারদের পেছন আছেন ১১৮ প্রভাবশালী ব্যক্তি। এদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু নেতাকর্মীরাও আছেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে হাটবাজার বসানো হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযানের পর রাজনৈতিক ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ দখলদারদের ফের দখলে সহায়তা করছেন। সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ১৬০ জন দখলদার আছেন ময়মনসিংহে। এ জেলার দখলদাররা ৫৯টি নদী-খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে খুলনা। এ মহানগর এলাকায় ১ হাজার ২২৯ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুটি নদীর বিভিন্ন অংশ দখল করেছেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর মহানগর বাদে খুলনা জেলায় সাতটি নদী-খালে দখলদার রয়েছেন ৮৯ জন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এ জেলায় দখলদারদের যারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন তারা সংখ্যায় ছয়জন। ৬০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ঢাকা জেলা ও মহানগর এলাকায় নদী দখল করেছেন।

নদী-খালের জমি দখলদারদের সঙ্গে স্থানীয় ভূমি অফিস ও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ থাকে। ফের দখলের ক্ষেত্রে এ ধরনের চক্রের সহায়তা কাজে লাগানো হয়। নদীদখলে ক্ষমতাসীন দলের অসাধু নেতাকর্মীদের দৌরাত্ম্য থাকায় জনগণের মধ্যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে।

ঘোষিত দেশব্যাপী নদীয় রক্ষায় ঝিনাইদহে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়েছে। কারণ দেশের সব নদ-নদীই প্রভাবশালীদের দখলে বলে প্রশাসনের কাছে তথ্য রয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সুনাম ফেরাতে তৎপর হলেও কতটুকু সরকার সফল হবেন অবৈধ দখলদার বিরুদ্ধে এ প্রশ্ন সর্বত্রই চাউর। কারণ দেশব্যাপী চলমান উচ্ছেদ অভিযানের মধ্যে থেমে নেই দখলদার কালো থাবা। প্রতিনিয়তই অভিযোগ আসছে বিভিন্ন মহল থেকে প্রভাবশালীরা অনেক ক্ষমতাধর।

পঞ্চম সংসদ অধিবেশনে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, সরকারের সম্পত্তি ও নদীর তীর দখল করে যারা নিজেদের প্রভাবশালী মনে করছেন তাদের চেয়ে প্রভাবশালী সরকার। তিনি হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, যেকোনো মূল্যে অবৈধ দখলদারদের কাছ সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা হবে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
দখল,সরকার,বিআইডব্লিউটিএ,উচ্ছেদ অভিযান
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close