জুবায়ের চৌধুরী

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

সাইবার অপরাধ

মামলা করলেও কমে না হয়রানি

জেবুন্নেসা হ্যাপী (ছদ্মনাম)। বয়স ২৯। থাকেন রামপুরা বনশ্রীতে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। সম্প্রতি তার নাম-ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলেছেন কেউ। সেই আইডি থেকে তার বন্ধু-স্বজনদের কাছে টাকা চাওয়া হয়। বাদ যায়নি বাজে মন্তব্য ও অশ্লীল ছবি পোস্টও। ভুয়া আইডির এমন কান্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন হ্যাপী। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এক বন্ধুর পরামর্শে থানায় যান তিনি। তাতেও কোনো লাভ হলো না। থানায় কোনো অভিযোগ না করেই ফিরে আসেন। পরে দীর্ঘদিনের জন্য নিজের আইডিটি বন্ধ করে দেন। একই ঘটনা ঘটে সিনথিয়া আলম ও আফরিন সুলতানার বেলায়ও। তবে এই তিন ভুক্তভোগীর কেউ-ই মামলা কিংবা জিডি করেননি। এ বিষয়ে তাদের একটাই জবাব, ‘মামলা করে আর হয়রানি হতে চাই না’।

জানা গেছে, ফেসবুক ব্যবহারের দিক থেকে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহারকারী। ঢাকার অবস্থান এখন বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। ফলে ফেসবুককেন্দ্রিক সাইবার অপরাধও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটি মেয়েদের পাঁচটি হলের প্রায় ২১০০ ছাত্রীর মধ্যে জরিপ চালিয়ে যে তথ্য উদ্ঘাটন করেছে তা আঁতকে ওঠার মতো।

এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই ফেসবুককেন্দ্রিক সাইবার অপরাধের শিকার। এতেই বোঝা যায়, অপরাধের নিরাপদ চারণভূমি হয়ে উঠছে ফেসবুক। ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা, ছবি এডিট করে গুজব ছড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়িয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের ঘটনাও ঘটে গেছে দেশে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এ ধরনের অপরাধগুলোকে। সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরও উন্নতি হয়নি পরিস্থিতির। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, ফেসবুক-সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে নারীরা কেমন সংখ্যায় অপরাধের শিকার হচ্ছেন, তার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়নি তদন্ত সংস্থাগুলোর কাছে। তবে এর বাইরেও কয়েকটি সংগঠন সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করে।

জাস্টিস ফর ওমেন বাংলাদেশের সাইবার অপরাধ বিশ্লেষক মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সংগঠন থেকে সহযোগিতা নিয়েছেন এমন ১ হাজার ২০০ ব্যক্তির ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, অপরাধের শিকার ৭০ শতাংশই নারী। দেশে সাইবার অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু অপরাধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না মামলা কিংবা এ-সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা।

ভুক্তভোগীদের ধারণা, মামলা তাদের হয়রানিকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবে। অন্যদিকে দেশে সাইবার অপরাধ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় প্রতিরোধ কিংবা প্রতিকার ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ২০১৩ সালে আদালতে সাইবার অপরাধ দমনে আলাদা ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের এ পাঁচ বছরে মাত্র ৫ শতাধিক মামলা বিচারাধীন। তবে গত তিন বছরে সংখ্যার হিসাবে মামলা বেড়েছে প্রায় ২০০ গুণ।

দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালের কাজ শুরু হয়। কিন্তু পরের বছর ট্রাইব্যুনালে আসে ৩২টি মামলা। ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ১৯৬, ২০১৭ সালে ২৯৬, ২০১৮ সালে ৫৬৬টি মামলা। সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম বলেন, চার বছরে সাইবার অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ২০০ গুণ। সাইবার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬৬ শতাংশ মামলারই সব আসামি খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ মাত্র ৩৪ শতাংশ মামলা প্রমাণিত হয়েছে। এর আগে তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ১৫ শতাংশ মামলা।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মানহানি ও শ্লীলতাহানি-সংক্রান্ত সাইবার অপরাধের বেশির ভাগ হচ্ছে ফেসবুক ব্যবহার করে। যার বেশির ভাগ শিকার হচ্ছেন নারীরা। তারা বলছেন, অনেকেই জানেন না যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গেলে এ বিষয়ে তারা সমাধান পাবেন। আর যারা আসেন তারা সামাজিকভাবে বিষয়টি জানাজানি হওয়ার ভয়ে মামলা পর্যন্ত যেতে চান না।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ৫ শতাংশ অভিযোগকারীর বিয়েবিচ্ছেদ ঘটেছে ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সন্দেহের কারণে। তাই সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটির নানা অভিযোগ সুরাহা করতেই ব্যস্ত থাকছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ইনসাইট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পরিচালক (অপারেশন) তানভীর হাসান জোহা বলেন, এখন ব্লগবেইজড ক্রাইম বেড়েছে। ফেসবুকে ছবি ডাউনলোড, ফেক আইডি, আইডি হ্যাকসহ নানা অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগকারীদের অনেকেই সন্দেহ-দ্বন্দ্বের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। একজন কলেজ শিক্ষিকা অভিযোগ করেছেন, তার স্বামী ২৪ ঘণ্টাই ফেসবুক ব্যবহার করেন। এতে তার সংসারে অশান্তি হচ্ছে। তিনি জানান, তারা তথ্য পান একটি প্রতিষ্ঠানেরই ২৭ জনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে ফেসবুককেন্দ্রিক অপরাধে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনৈতিক সম্পর্ক ও সন্দেহ তৈরি করছে ফেসবুকের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার।

বর্তমানে সিআইডি, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং র‌্যাবের সাইবার অপরাধ তদন্তবিষয়ক আলাদা সেল রয়েছে। সংস্থাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, থানায় মামলা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাইবার অপরাধ বিষয়ে তেমন একটা দক্ষতা নেই। তাই এ ধরনের কোনো অভিযোগ এলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তারাই বুঝে উঠতে পারেন না কী করবেন। এতে অনেকেই সমাধানও পাচ্ছেন না।

প্রসঙ্গত, ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে অপরাধ করা হয় সেটিই ‘সাইবার ক্রাইম’। উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধকে অপরাধের তালিকায় শীর্ষে স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগে মানুষ বাস্তব জগতের চেয়ে ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করছে অনেক বেশি। এই ভার্চুয়াল জগতের কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনাচার, চিন্তাজগৎ ও মনোবৃত্তি। তাতে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ভিন্ন প্রকৃতির অপরাধ প্রবৃত্তি। সাইবার পর্নোগ্রাফি, হ্যাকিং, স্প্যাম, ব্লু হোয়েলের মতো অ্যাকশন গেম, সাইবার বুলিং, ইমেইল স্পাম ও পিশিং, অনলাইন কেলেঙ্কারি ও প্রতারণা, পরিচয় ও তথ্য চুরি, ই-কমার্স ও অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণা, বিভিন্ন সেক্সুয়াল সাইটে নারী ও শিশুদের অপব্যবহার, বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য সাইবার অপরাধের আওতায় পড়ে। আরো রয়েছে ইলেকটনিক মানি লন্ডারিং, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র, সাইবার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মামলা,হয়রানি,সাইবার অপরাধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close