জুবায়ের চৌধুরী

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৮

ফুটেজ দেখেও অপরাধী ধরতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আসামি ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এই প্রযুক্তি মানুষের জীবন মানের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে। আবার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় নজরদারি করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তি কিংবা সাংগঠনিকভাবে নিজেদের নিরাপত্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করছেন। কখনো কখনো সেসব ক্যামেরায় অপরাধের ফুটেজও সংরক্ষণ হচ্ছে। তবে অপরাধের ফুটেজ পেলেও অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

অন্যদিকে বিভিন্ন সময় অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে বা তাদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে পুলিশ, র‌্যাব ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বছরের পর বছর আহ্বান জানিয়ে আসছে। অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু তাদের এই ক্রমাগত আহ্বান সত্ত্বেও কোনো সাড়া পাওয়ার নজির নেই। ২০০১ সালে সরকার ঘোষিত শীর্ষ ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে পলাতক জঙ্গি, বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনাকারী, পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত ১২ বার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। সেসব ঘোষণায় সন্দেহভাজনের ছবি প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে। আবার খুনি, সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গিদের ধরিয়ে দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ছবি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কিছুতেই জনসাধারণের সাড়া মেলেনি।

ফুটেজ মেলে তবু আসামি অধরা : ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে গৃহকর্ত্রী শাহিদা বেগমকে (৫০) হত্যা করে স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যায় এক যুবক। এরপর ২১ আগস্ট দক্ষিণখানের তেঁতুলতলা রোডে গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে (৫২) একই কায়দায় হত্যা করে ওই খুনি। ১০ দিন পর ৩১ আগস্ট দক্ষিণখানের মুন্সী মার্কেট এলাকায় জেবুন্নিছা চৌধুরীকে (৫৬) কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় সে। এর মাত্র ৭ দিন পর ৭ সেপ্টেম্বর ওই একই খুনি একইভাবে দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে গৃহকর্ত্রী ওয়াহিদা আক্তারকে (৪৮) খুন করে এবং যথারীতি পালিয়ে যায়।

৪৫ দিনের মধ্যে প্রায় একই কায়দায় ৪ নারী খুন হওয়ার পর পুলিশ জানায়, প্রতিটি ঘটনাই একই ধরনের। একজন ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলার বাড়ি ভাড়ার কথা বলে ওই ৪ নারীকে খুন করেছে। ঘাতককে গ্রেফতারে ওই যুবকের একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে ডিএমপি। ফুটেজ দেখে সিরিয়াল কিলার শনাক্ত হওয়ার ২ বছর পেরিয়ে গেলেও তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে উত্তরায় চার নারী খুনের পর চলতি বছরের ৮ মার্চ তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় বাড়ির মালিক আমেনা বেগম (৭০) খুন হন। পুলিশের সন্দেহ এটিও সেই সিরিয়াল কিলারের কাজ। কিন্তু একের পর এক কিলিংয়ের পর ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা ফুটেজে চিহ্নিত হয়েও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সেই সিরিয়াল কিলার।

শুধু এই সিরিয়াল কিলারই নয়, এ ধরনের বিভিন্ন আলোচিত ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ মিললেও আসামিরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক ক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়লেও ক্যামেরার দুর্বলতার কারণে অপরাধীদের চেহারা ঠিকমতো বোঝা যায় না। ফলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এতে সিসি ক্যামেরা আছে জেনে শুনেও অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না অপরাধীরা। এ অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যকারিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত ১৪ জুলাই গভীর রাতে মহাখালীর স্কুল রোডে কথিত অনলাইন নিউজপোর্টাল রেইনবো নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কার্যালয়ে কাজী রাশেদ নামে এক যুবলীগ নেতা খুন হন। ঘটনার পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত ৩টা ৪ মিনিটে হাতে পলিথিনের ব্যাগ পেঁচিয়ে রাশেদের নিথর দেহ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে চার যুবক। পরে সেই চার যুবকের পরিচয়ও শনাক্ত হয়। কিন্তু এ হত্যাকান্ডের প্রধান সন্দেহভাজন সুন্দরী সোহেলসহ বাকি চারজনের কেউই এখনো গ্রেফতার হয়নি।

গত ৪ আগস্ট তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িতে সাগরিকা তৃপ্তি (১২) নামে এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পালিয়ে যায় এক যুবক। তার পালিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই যুবককে গ্রেফতার করা যায়নি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকালে গত ৪ আগস্ট মিরপুরে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ৫ আগস্ট ঝিগাতলায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় ফুটেজে আসামিদের চেহারা স্পষ্ট, কিন্তু কাউকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। গত ২১ আগস্ট সাভারের গেন্ডা বাসস্ট্যান্ডে পুলিশের স্থাপিত সিসি ক্যামেরার নিচেই খুন হন মারুফ খান নামে এক যুবক। অথচ খুনিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না।

এর আগে ২০১৫ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আলোচিত যৌন হয়রানির ঘটনায় ফুটেজ দেখে আসামি শনাক্ত হয়। তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু কাউকেই আইনের আওতায় আনা যায়নি। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকান্ড, ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকান্ড, ৩১ অক্টোবর আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন হত্যাকান্ড ও ২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে পুলিশ সুপারের (এসপি) স্ত্রী হত্যাকান্ডসহ আরো কয়েকটি হত্যাকান্ডে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আসামি শনাক্ত হয়েছে। কিছু কিছু ঘটনায় অবশ্য আসামি গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু সিসি ক্যামেরা ফুটেজ অস্পষ্ট হওয়ায় সাক্ষ্য প্রমাণে তা কোনো কাজে আসেনি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, সিসি ক্যামেরার ব্যবহার দেশে এখনো কালচার হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এসব ব্যবহারের জন্য যে ম্যানেজমেন্ট ও জনবল দরকার সেটিও নেই। ফলে সিসি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা বিভিন্ন ফাঁক গলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিসি ক্যামেরা বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। তাই পুলিশ ঘটনার সময়ের ফুটেজ পাচ্ছে না। আবার ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও অস্পষ্ট থাকায় অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম বলেন, ফুটেজ দেখে আসামি গ্রেফতার হয় না, এটা ঠিক নয়। ইতোমধ্যেই অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে ফুটেজের মাধ্যমে। নিম্নমানের ফুটেজের কারণেই আসামি শনাক্তে সমস্যা হচ্ছে। আমরা আশা করি, প্রতিটি এলাকায় সিসি ক্যামেরা স্থাপিত হলে অপরাধ আরো কমে যাবে।

পুরস্কারেও সাড়া মেলে না : অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে কিংবা তাদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে বিভিন্ন সময় পুরস্কার ঘোষণা করে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু তাদের এই আহ্বান সত্ত্বেও সাড়া পাওয়ার কোনো নজির নেই। ২০০১ সালে সর্বপ্রথম শীর্ষ ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। এরপর বিগত বছরগুলোতে পলাতক জঙ্গি, বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনাকারী, পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী বা যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত ১২ বার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কখনো কখনো সন্দেহভাজনের ছবিসহ বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় খুনি, সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গিদের ধরিয়ে দিতে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী,অপরাধী,ফুটেজ,খুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close