এস এইচ এম তরিকুল ইসলাম, রাজশাহী

  ০৭ অক্টোবর, ২০১৮

রাজশাহীতে দেদার বিক্রি হচ্ছে ক্ষতিকর শক্তিবর্ধক

বোধশক্তি শূন্য ও মৃত্যুঝুঁকিতে যুবসমাজ

‘শক্তিবর্ধক’, ‘যৌন শক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকর’, ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ভেষজ দিয়ে তৈরি’ ওষুধ বা বোতলের গায়ে লেখা রয়েছে এ রকম বিভিন্ন রকম কথা। অথচ এসব তথাকথিত ওষুধ নিষিদ্ধ হলেও বিক্রিতে কোনো রাখঢাক নেই বরং রাজশাহীতে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। শরীরের জন্য এসব ক্ষতিকর পণ্য ডিসপেন্সারিসহ দোকানে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এসব তথাকথিত ওষুধ সবচেয়ে ব্যবহার করছে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা। চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। তাই এক ব্যবসায়ীর দেখা দেখি অন্যরাও বিক্রি করেছে। বর্তমানে শুধু শহরেরই দোকানে নয়, রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের দোকানেও সয়লাব হয়ে গেছে এসব আজে-বাজে ওষুধে। এ বিষয়ে নেই ওষুধ প্রশাসনের তদারকি বা কোনো নিয়ন্ত্রণ। এ কারণে দিন দিন এ ধরনের অবৈধ ওষুধ কোম্পানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এসব যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ বা পানীয় পান করে সহজেই বোধশক্তি শূন্য এবং ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুঝুঁকিতে ধাবিত হচ্ছে যুব সমাজ। তবে প্রশাসনের মন্তব্য হচ্ছে এসব ধমনে আরো জোরদার অভিযান চালানো হবে।

কখনো কখনো প্রশাসনের অভিযানে এগুলো বিক্রি বন্ধ করে দিলেও আবার নাম পাল্টে এসব উত্তেজক ওষুধ ও পানীয় নতুন করে বাজারজাত হচ্ছে। কিন্তু যারা এসব খাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই জানেন না তারা আসলে কী ক্ষতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুধু শক্তিবর্ধক লেখা দেখেই এসব পণ্যের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তারা। যেগুলোর একটিরও নেই সরকারি কোনো অনুমোদন।

রাজশাহীর অধিকাংশ ডিসপেন্সারি, পান-সিগারেট, মুদি ও কনফেকশনারির দোকানগুলোতে প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানির যৌন উত্তেজক এসব পণ্য। বিশেষ করে সন্ধ্যা হলেই দোকানে ভিড় জমায় যুবক থেকে মধ্য বয়সীরা। বেশকিছু পণ্যের মধ্যে অ্যালকোহলের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকায় মোড়কের গায়ে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লোগো। যা অনুমোদিত। কিন্তু এসব পানীয়র বাইরে হারবাল উপাদান দিয়ে তৈরি অতিমাত্রায় অ্যালকোহল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে ‘শক্তিবর্ধক’ বলে প্রচার দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে বেশকিছু পানীয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মহানগরীর লক্ষ্মীপুর, সাহেববাজার ও তালাইমারী মোড়ের একাধিক ডিসপেন্সারিসহ অন্য দোকানিরা জানান, বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তুতকৃত যৌন উত্তেজক ড্রিংকসের মধ্যে পাওয়ার, ডাবল পাওয়ার, ভায়াগ্রা, ইনটিমিট, টায়াগ্রা, নিশাত সিলভার, ডাবল হর্স, হর্স পাওয়ার, ম্যান পাওয়ার, পাওয়ার ম্যান, তৃপ্তি পাওয়ার, মাশরুম, ফানটুস, কস্তুরি হারবাল সিরাপ, নাইট পাওয়ার উল্লেখযোগ্য।

রাজশাহী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল এলাকায় ‘শক্তিবর্ধক’ পানীয় পান করা অবস্থায় ছুটিতে আসা এক সেনাবাহিনী সদস্য বলেন, ছুটিতে এসে বাড়ি ঢোকার আগেই খাই। খাওয়ার পর যা দেখি তাই ভালো লাগে। সবকিছু দেখে মনে হয় যেন রঙিন দুনিয়ায় হাঁটছি। তবে এগুলো খেতে তিতা লাগে, কান গরম হয়ে যায়। কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না খারাপ তা জেনে খাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারের বেশিরভাগ দোকানেই যখন এগুলো পাওয়া যায় তাহলে জিনিস তো ভালোই মনে হয়, এগুলোতে অনুমোদন না থাকলে বাজারে আসে কি করে? আর এলেও যদি এসব পানীয় স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হয়ে থাকে তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যারা আছে তারা এগুলো বিক্রিতে বাধা দিচ্ছে না কেন? তিনি বলেন, আমি তো একাই পান করি না।

কৌশলে রাজশাহী নগরীর বাইপাস এলাকার একটি গুদামে ঢুকে দেখা যায়, লাখ লাখ পিচ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। জানতে চাইলে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন বলেন, ‘যেকোনো মুহূর্তে এনার্জি ড্রিংক বন্ধে অভিযান পরিচালিত হতে পারে। আর নিষিদ্ধ জিনিসেরই দাম বেশি বাড়ে। আর ওই অতিরিক্ত লাভের ব্যবসা করার জন্যই প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলাম। ভালো ভালোই ব্যবসাটা করতে পারলে দুই তিন মাসের মধ্যেই হয় সেটার কোটি টাকা লাভ হবে।’

সূত্র মতে, সম্প্রতি বিএসটিআইয়ের এক সভায় ‘এনার্জি ড্রিংকস’ শিরোনামে জাতীয় মান প্রণয়ন না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং কার্বোনেটেড বেভারেজ ব্যতীত ‘এনার্জি ড্রিংকস’ বা অন্য কোনো নামে পণ্য উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতের কোনো সুযোগ নেই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাজারে বিক্রিত এনার্জি ড্রিংকসের মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে গতকাল শনিবার রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. মো. সঞ্জিত কুমার সাহা প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, বাজারের প্রায় প্রতিটি দোকানেই ‘শক্তিবর্ধক’ হিসেবে যে এনার্জি ড্রিংকস বিক্রি হচ্ছে তা স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। ক্ষণস্থায়ীভাবে উপকৃত হলেও দীর্ঘস্থায়ী পান করলে পুরুষত্ব নষ্ট করে দেয়। লিভার ও কিডনি যেকোনো সময় কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। এসব খাওয়া থেকে দূরে থাকা দরকার। কেননা এসব খাওয়ার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাছাড়া যৌন শক্তিবর্ধক, চিকন থেকে মোটা হওয়া, ওজন বাড়ানো ও ফর্সা হওয়ার জন্য যেসব ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো কখনো গ্রহণ করা উচিত নয়।

তিনি বলেন, এসবের ওপর ওষুধ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে দিন দিন এ ধরনের অবৈধ কোম্পানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ ব্যবসার লাইসেন্স না থাকলেও অধিক লাভের আশায় দোকানিরা দেদার বিক্রি করছে। এ ধরনের পণ্যের চটকদারি বিজ্ঞাপন থাকায় কিছু মানুষ তাদের যৌন দুর্বলতা না ধরা দিতেই মূলত ক্ষতিকারণ এসব যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ ও কোমল পানীয় খাচ্ছে। যা দেখভাল করার দায়িত্ব বিএসটিআই ও ওষুধ প্রশাসনের। তাদের নিয়মিতভাবে বাজারে তদারকি করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলেও জানান তিনি।

গতকাল শনিবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক অপূর্ব অধিকারী জানান, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। তবে এক দোকানে অভিযান করতে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়। খোলা থাকলেও এসব ড্রিংকস সরিয়ে ফেলে। এ অভিযান আরো জোরদার করা হবে বলেও জানান তিনি।

পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
শক্তিবর্ধক,অবৈধ ওষুধ ও যৌন উত্তেজক,রাজশাহী,ওষুধ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close