জুবায়ের চৌধুরী

  ০৫ জুন, ২০১৮

প্রবাসী ও সুন্দরী পাত্রীর কথা বলে বিয়ের ফাঁদ!

*ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণা, বিয়ে হলেও বাসর হয় না *বিনা খরচায় আমেরিকা-ইংল্যান্ড পাঠানোর প্রলোভন

রবিউল হক (ছদ্মনাম)। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পত্রিকায় ‘কানাডা প্রবাসী সিটিজেন পাত্রীর জন্য পাত্র চাই’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দেখে ফোন দেন। অপরপ্রান্তের ভদ্রলোক দেখা করতে আমন্ত্রণ জানান। পরদিন তাদের দেওয়া ঠিকানায় যান। আলাপের একপর্যায়ে রবিউলকে জানানো হয়, কানাডা যেতে হলে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হবে। অথচ ওই বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল ‘পাত্র পছন্দ হলে কোনো টাকা লাগবে না’। ওয়ালিউর বিজ্ঞাপনের কথা মনে করিয়ে দিলে প্রতারকরা তাকে জানান, ‘এটা পাত্রীর জন্য নয়, আমাদের খরচ’। রবিউল জমানো এক লাখ টাকা তুলে দেন প্রতারকদের হাতে। পাসপোর্টও জমা দেন। পাত্রীর সঙ্গে কথা বলে বাকি টাকা পরিশোধ করবেন বলে প্রতারকদের জানিয়ে দেন। কিন্তু বাকি টাকা না নিয়েই চম্পট মারে প্রতারকরা।

কেস স্টাডি-২ : বনানীর বাসিন্দা নাইমা (ছদ্মনাম)। ২২ বছর বয়সী এই রূপসীর প্রেমের ফাঁদে পড়েন চাকরিজীবী আসিফ (ছদ্মনাম)। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি কাজী অফিসে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের দুই বছর পর আসিফ জানতে পারেন, এর আগেও নাইমার বিয়ে হয়েছিল। সেই পক্ষের একটা মেয়েও আছে। এখনো আগের স্বামীর কাছ থেকে প্রতি মাসেই মোটা অঙ্কের টাকা নেন নাইমা। এই তথ্য জানার পর দুজনের মধ্যে শুরু হয় মনোমালিন্য। বিয়েবিচ্ছেদ চাইলে আসিফের কাছে কাবিনের পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন নাইমা। টাকা না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। উপায়ন্তর না দেখে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বাধ্য হন আসিফ।

রবিউল, আসিফের মতো আজিজুল ইসলাম নামে এক যুবকও আমেরিকা যাওয়ার জন্য প্রতারকদের একটি চক্রকে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। তাদের মতো এ রকম অসংখ্য সরলমনা যুবক প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছেন গজে উঠা ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণার ফাঁদে। বিয়ের পর বর-কনেকে স্বপ্নের দেশ ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হবে বলে প্রতিদিনই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীজুড়ে প্রতারণার এ রকম অভিনব ফাঁদ পেতে রেখেছে সংঘবদ্ধ একটি প্রতারক চক্র। নামে-বেনামে গড়ে উঠা এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই বৈধ অনুমোদন নেই। মাঝেমধ্যে প্রতারণা করার অভিযোগে এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও পরে তারা জামিনে বের হয়ে একই ব্যবসায় ফিরে আসে। গ্রেফতার, জেল-জরিমানার খড়গ থাকলেও ম্যারেজ মিডিয়ার নামে প্রতারণা বন্ধ হচ্ছে না। এদের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার এমন অনেক ঘটনাও আছে, পাত্র-পাত্রীর বিয়ে হয় কিন্তু বাসর হয় না। তার আগেই পাত্রের মালামাল লুট করে পালিয়ে যায় কথিত স্ত্রী।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীতে কয়েকশ সুন্দরী তরুণী এভাবে বিয়ে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো যৌন সম্পর্ক করার প্রলোভন দেখিয়ে বিত্তবানদের ব্ল্যাকমেইল, কখনো প্রেমের ফাঁদে ফেলে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের মতো ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় সদস্য জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন সুন্দরী এ ললনারা।

এমনই এক সুন্দরী প্রতারকের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; যা নিয়ে হতবাক পুলিশ। পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ভুয়া বিয়ে করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া এক সুন্দরী নারী প্রতারক চক্রের সন্ধান মিলেছে। অহিদা বেগম কবিতা নামের ওই নারী গড়ে তুলেছেন বিশাল এক প্রতারক চক্র। চক্রে ভুয়া শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালিকা, আত্মীয়স্বজন, খালা-খালু ও বিয়ে পড়ানো কাজী থেকে শুরু করে সব ধরনের আত্মীয়স্বজন রয়েছে। বিয়ে করার পর কারো বোঝার উপায় নেই যে, তার স্ত্রীর পক্ষের সব আত্মীয়স্বজনই ভুয়া। কবিতা বিয়ের পর ছয় থেকে সাত মাস পর্যন্ত সংসার করে। ওই সময়ের মধ্যেই টার্গেটকৃত ব্যক্তির মন জয় করে নগদ টাকা, দামি দামি আসবাব, স্বর্ণালঙ্কার, জমি, ফ্ল্যাট হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। চক্রটির হাতে সাতজনের প্রতারিত হওয়ার তথ্য মিলেছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে কতজন প্রতারিত হয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। পাঁচ বছরে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ।

জানা গেছে, চক্রটির টার্গেট চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ। একটি প্রতারণার মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, অনেক প্রতারণার মামলা তারা তদন্ত করেছেন, কিন্তু এ ধরনের অভিনব প্রতারণার ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো। ভাগ্য ফেরানোর সন্ধানে ঢাকায় আসে কবিতা। ভাগ্যের পরিবর্তনও করেছে। তবে অসৎ পথে।

প্রতারণার অংশ হিসেবে কবিতা মুগদার বাসিন্দা আকরাম হোসেন চৌধুরী ওরফে লিটনকে (৬৪) টার্গেট করে। কয়েক মাসের চেষ্টায় স্ত্রীহারা লিটনকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম হন কবিতা। একপর্যায়ে লিটন-কবিতার বিয়েও হয়। সংসারও হয়। লিটনকে খুশি করে বাড়ির জন্য দামি ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাবপত্র, ভাইকে বিদেশ পাঠানোর নামে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ছাড়াও নানা উছিলায় টাকা হাতিয়ে নিতে থাকেন কবিতা। এভাবে ছয় মাস টাকা হাতিয়ে নেন। এরপর লিটন সন্দেহ করতে থাকলে কবিতা আর তার সঙ্গে সংসার করবে না বলে জানান।

সর্বশেষ কবিতা স্বামীর কাছ থেকে ঈদের বাজার করার কথা বলে নগদ প্রায় সোয়া লাখ টাকা নেন। এরপর লিটন তার অসুস্থ মাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে গেলে কবিতা তার চক্রের সদস্যদের নিয়ে বাড়িতে থাকা সব স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। সব মিলিয়ে কবিতা শুধু টাকা, স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা। লিটন গ্রাম থেকে বাড়িতে এসে দেখেন ঘরে কোনো টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নেই। ঘরে স্ত্রীও নেই। এরপর স্ত্রীর দেওয়া ঠিকানা মোতাবেক খোঁজ করতে গিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। সব ঠিকানা ভুয়া। এমনকি এত দিন কবিতার পিতা-মাতাসহ যত আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন, তাদের কারো কোনো খোঁজখবর নেই। কারো কোনো হদিস নেই। এমনকি বিয়ে করানো কাজী অফিসে গিয়ে দেখেন, সে নামে কোনো কাজীই নেই।

এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং পারিবারিক অনুশাসন না থাকায় উচ্চাভিলাষী কিছু নারী প্রতারণায় নেমেছেন। তবে এ ধরনের প্রতারণা করা একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওইসব তরুণীর অবৈধ আয়ের ভাগ পায় সবাই। এটি প্রশাসনের অজানা থাকার কথা নয়। এ ধরনের অপরাধ বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ার আগেই রোধ করা না গেলে দেশ এবং নতুন প্রজন্মের জন্য হতে পারে অশনিসংকেত।

ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ম্যারেজ মিডিয়ার নামে সুন্দরী তরুণীদের বিদেশি নাগরিক পরিচয়ে একটি চক্র প্রতারণা করে থাকে। প্রতারক চক্র বিভিন্ন পত্রিকায় ‘সুন্দরী বিদেশি কন্যার জন্য যোগ্য পাত্রী চাই’ শিরোনামে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। তারা বিয়েতে আগ্রহী যুবককে তরুণীর জাল ভিসা ও পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। একপর্যায়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে অফিস পরিবর্তন করে আবারও একই ব্যবসায় নামে চক্রটি। এভাবেই তাদের প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্ব হারাচ্ছে একশ্রেণির সরলমনা যুবক। এ ধরনের প্রতারকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রতারণা,ম্যারেজ মিডিয়া,পাত্র চাই,বিয়ে,ফাঁদ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist