জুবায়ের চৌধুরী

  ৩০ মে, ২০১৮

মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান

কে তাড়াবে সরষের ভূত!

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানকে অনেকেই সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তবে অনেকের প্রশ্ন, মাদক কারবারে জড়িত চুনোপুঁটিদের বেছে বেছে ধরা হচ্ছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু রাঘলবোয়ালরা ধরা পড়ছে না। আর দেশে মাদকের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। অনেকের প্রশ্ন, এখন যে হারে মাদক কারবারি ধরা পড়ছে, তাহলে এত দিন ধরা পড়েনি কেন? অথচ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর মাদকবিরোধী অভিযান এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এখন প্রশ্ন ওঠেছে, মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এই বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সদস্য মাদক কারবারিতে সরাসরি জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি তালিকা জমা দিয়েছে। ওই তালিকায় বলা হয়েছে, পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা মাদক কারবারিদের সরাসরি সহায়তা করছেন। অনেক সদস্য নিজেই মাদক কারবারি চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার পুলিশের অনেক কর্মকর্তার যোগসাজশে তাদের সোর্সরা মাদক কারবারি করে আসছেন। মাদক কেনাবেচায় জড়িত এমন প্রায় ২০০ পুলিশ কর্মকর্তার একটি তালিকা জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। দোষী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যেসব পুলিশ সদস্য মাদক গ্রহণ করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে চিঠিতে। বাহিনীর সদস্যদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্ট (মাদক পরীক্ষা) ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে আটটি অপরাধ বিভাগের সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর সোর্স বা ফর্মারা চলমান অভিযান ঘিরে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ সোর্সরাই মাদকবিরোধী অভিযানের তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন বলে অভিযাগ পাওয়া গেছে। এ কারণে ভেস্তে যাচ্ছে অভিযান। সম্প্রতি রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্প, কড়াইল বস্তি, কমলাপুর এবং টিটিপাড়া বস্তিসহ কয়েকটি স্থানে হাজার হাজার র‌্যাব-পুলিশের বড় অভিযান পরিচালিত হলেও তেমন কোনো সফলতা পাওয়া যায়নি। অভিযানে বেশ কিছু মাদকসেবী ও খুচরা বিক্রেতা গ্রেফতার হলেও বড় মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়েননি। আগেই অভিযানের খবর পেয়ে তারা পালিয়ে যান। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, পুলিশ সোর্সরা শুধু মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতাই করে না, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিজেরাই সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তাদের নামে বেশ কয়েকটি করে মাদক, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মারামারি, এমনকি হত্যা মামলাও রয়েছে। ডিএমপির একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসহারা আদায় করেন সোর্সরা। যেসব মাদক ব্যবসায়ী তাদের টাকা দিতে না চান, তাদের পুলিশে সোপর্দ করে সোর্সরা। তাই মাদক ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো পুলিশের চেয়ে কথিত সোর্সদের বেশি ভয় পান।

সূত্র আরো জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অসাধু পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশে সোর্সরা নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশের কাছ থেকে হ্যান্ডকাফ নিয়ে তা দেখিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে আদায় করে অর্থ। হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। অনেক সময় সোর্স মানি হিসেবে তারা পুলিশের কাছ থেকে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক নিচ্ছেন। ওই মাদক তারা বিক্রি করছেন মাদকসেবীদের কাছে। তাছাড়া প্রায়ই সোর্সদের ভুয়া তথ্যে অভিযানে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর মডেল থানা পুলিশের সোর্স ফয়সাল, খ্রিস্টান বাবু, রিপন, জসিম, ফিরোজ এবং নাসির সরাসরি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তাদের মধ্যে ফয়সাল ইয়াবার বড় ডিলার। সে নিজেই টেকনাফ থেকে ইয়াবা আনেন। এলাকায় তিনি কোটিপতি ফয়সাল হিসেবে পরিচিত। গত ২৬ মে রাজধানীর শ্যামলী শিশুমেলার সামনে থেকে রবিউল ইসলাম সানি নামে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, পল্লবী থানা পুলিশের দুই সোর্স সোহেল ওরফে বিল্লু এবং সায়মন বাসা থেকে ডেকে নিয়ে সানিকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পুলিশের দুই সোর্সকে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।

পুলিশ সোর্সের অপকর্মের বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়িত হলে তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। বিষয়টি নিয়ে ডিএমপি সদর দফতরের অবস্থান জিরো টলারেন্স। তিনি জানান, নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুলিশের সোর্সনির্ভরতা অনেক কমে গেছে। এখনো যারা সোর্স হিসেবে কাজ করেন তারা যাতে কোনো ধরনের অপকর্মে জড়াতে না পারেন, সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।

মাদকের বিস্তৃতির পেছনে রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের কিছু প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের মদদেই দেশের প্রতিটি এলাকায় মাদকের কারবার চলে। মাদকের আখড়া ও চিহ্নিত মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা নেয় এসব সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সারা দেশে দুই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি মাদক কারবারে মদদ দিচ্ছেন। প্রমাণ হাতে না পাওয়ার কারণে গণমাধ্যম এসব প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করে না। গোয়েন্দা তালিকায় নাম আছে—এমন বরাতে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তারা এসবকে ‘প্রতিপক্ষের অপবাদ’ বলে এড়িয়ে যান। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেই মাদক কারবারে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ বেশি।

গোয়েন্দা, পুলিশ সদর দফতর ও স্থানীয় পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পুলিশের চার শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। বদলি ছাড়া তেমন কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি অভিযুক্তদের। গত ৪ মে বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রায় ১২০ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজশাহীর পুঠিয়ায় নিহত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী মন্ডল ছিলেন উপজেলার বানেশ্বর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। আর টেকনাফের সরকারদলীয় পৌর মেয়র একরামুল হক অন্যতম।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, বছরে শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। গত বছরের প্রথম ছয় মাসেই মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ৬৭ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার বিভিন্ন ইউনিটের ২৩ জন। কক্সবাজারে মাদক কারবারে সহায়তা করার অভিযোগ উঠে টেকনাফ ও উখিয়া থানার ১৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নাম আসার পর টেকনাফ থানার এসআই আলমগীর, এসআই সরোজ আচার্য, সামিউর রহমান, পিএসআই সাইদুল, এএসআই আযহার ও কনস্টেবল বারী, আমিরুল এবং থানার ওসি জহিরুল ইসলাম, এসআই রাজেশ বড়ুয়া, দিদার মিয়া, প্রবোদ দাশ, এএসআই হাসানকে বদলি করা হয়। গত ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের বন্দরের রূপালী এলাকার বাসা থেকে পুলিশের এ এসআই আলম সরোয়ার্দী রুবেলকে ৪৯ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে জেলা ডিবি পুলিশ। আদালতে তার দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আরো পুলিশের জড়িত থাকার তথ্য মিলে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানায়, গত এক বছরে পুলিশের ৭২ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ, যাদের কয়েকজন মাদক কারবারিতে জড়িত ছিল। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সহেলী ফেরদৌস বলেন, ‘মাদকে জড়িত থাকলে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের চেয়ে তাদের শাস্তি বেশি। কারণ অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করে তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি মামলায় গ্রেফতার করা হয়।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান,বন্দুকযুদ্ধ,মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist