শরীফুল রুকন, চট্টগ্রাম

  ১৯ এপ্রিল, ২০১৮

মাদক পাচার ও পুলিশের ওপর হামলা

আসামির ভুল নাম : পার পাচ্ছেন জড়িতরা

মাদক চোরাকারবার ও পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত আসামিদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় এজাহারে থাকছে না। এসব ঘটনার মামলায় এক শব্দে আসামির নাম উল্লেখ করেই দায়িত্ব শেষ করছে পুলিশ। এ কারণে পরবর্তীতে সঠিক ঠিকানা না পাওয়ায় আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলায় আসামির ভুল পরিচয়ও উল্লেখ করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত কয়েকটি মাদক মামলার নথিপত্র দেখে এ তথ্য জানা গেছে।

চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানার ওসি নেজাম উদ্দিন বলেন, মাদকসহ গ্রেফতার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জড়িত বাকিদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় না। কারণ, মাদক মামলার বেশিরভাগ আসামি ভাসমান। প্রকৃতপক্ষে একজন আরেকজনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানে না। ফলে চেষ্টা করেও অনেকের বাবার নাম ও স্থায়ী ঠিকানা জানা যায় না।

গত ২৭ মার্চ নগরের পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা থেকে মো. আরজুকে গ্রেফতারের পর তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে দুইটি এলজি ও ১০ হাজার ইয়াবা পায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় সদরঘাট থানায় দায়েরকৃত মামলায় আরজুর দলনেতা সাহাবুদ্দিন ও মাঈন উদ্দিনকে আসামি করা হলেও তাদের বাবার নাম ও পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। একইদিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, আরজু বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদন্ডীর হাসেম মিস্ত্রির বাড়ির আবুল হাশেম মাস্টারের ছেলে। তার বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর, ডবলমুরিং থানায় ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর ও সদরঘাট থানায় চলতি বছরের ৮ ও ১১ জানুয়ারি দায়েরকৃত মোট চারটি মামলা রয়েছে।

পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না থাকায় মামলার দায় থেকে আসামির বাদ পড়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মাদক ব্যবসায়ী মো. আরজু। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর কদমতলী ব্র্যাক কোয়ার্টার কলোনি থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৬৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারের ঘটনায় ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়; এই মামলার আসামি মো. আরজুর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তুলে ধরা হয়নি। ফলে গত ২৭ মার্চ আরজুকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে যে চারটি মামলা থাকার তথ্য পুলিশ দিয়েছিল, এরমধ্যে ২০১৭ সালে ৬৫০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারের মামলাটি নেই। এর আগে ২০১৭ সালের ৫ মে বিকেলে বরিশাল কলোনিতে মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে খসরু ও পাভেল নামের দুইজনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও পুলিশের যৌথ দল। এ সময় ৪০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। একপর্যায়ে অভিযান দলের ওপর হামলা চালিয়ে দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ঘটনায় সদরঘাট থানার এসআই নয়ন বড়–য়া ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক মো. আবুল কাশেম পৃথক দুটি মামলা করেন।

প্রতিটি মামলা ২০ জনের নাম উল্লেখ এবং ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। নাম উল্লেখ করা ২০ আসামির মধ্যে বাবার নাম ও ঠিকানা আছে মাত্র পাঁচজনের। বাকি ১৫ আসামির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নেই, তাদের নামগুলো এক শব্দের। নামগুলো হচ্ছে মনোয়ারা, পারুলী, মনির মা, মনির, শামীম, শরীফ, বিপ্লব, বিলাই মনির, কাশেম, জামাল, পলাশ, রুবেল, সোসাইটি মনির, সুমন ও জাফর।

মামলা দুটি তদন্ত করেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. মাহবুব আলম। তদন্ত শেষে গত ৭ জানুয়ারি পৃথক দুটি মামলার প্রত্যেকটিতে চারজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তিনি। দুই মামলায় পূর্ণাঙ্গ পরিচয় না থাকা ১৫ আসামি ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক কারবারি ফারুককে বাদ দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এসআই মো. মাহবুব আলম বলেন, মারা যাওয়ায় ফারুককে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এজাহারে উল্লেখ থাকা ১৫ আসামির সঠিক নাম ও ঠিকানা পাওয়া যায়নি, তাই তাদেরকেও বাদ দিতে হয়েছে। পরে তাদের নাম-ঠিকানা পেলে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হবে।

এদিকে, ২০১২ সালের ৪ জুন শুভপুর বাসস্টেশন এলাকা থেকে ফেনসিডিলসহ আল আমিন নামের একজনকে গ্রেফতার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। এ ঘটনায় এসআই হারুন-অর-রশিদ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরমধ্যে সোহাগ, ফ্ল্যাক্স লিটন, জসীম, আবদুল কাদের প্রকাশ ডাইল কাদের ও নসু নামের পাঁচজনের বাবার নাম ও স্থায়ী ঠিকানা দেওয়া হয়নি।

বাবার নাম অজ্ঞাত লেখার পাশাপাশি কিছু মামলায় আসামির পরিচয়ে ভুল তথ্যও থাকছে। ২০১২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নালাপাড়া বাস্তুহারা কলোনিতে মাদকবিরোধী অভিযানে গেলে পুলিশের ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানার এসআই সফিকুল ইসলাম ২২ জনের নাম উল্লেখ ও ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা করেন। এরমধ্যে মাত্র তিনজনের বাবার নাম ও ঠিকানা লেখা হলেও বাকি ১৯ জনের বাবার নাম ও সঠিক ঠিকানা নেই। শুধু তাই নয়, এই মামলার দুই ও তিন নম্বর আসামি ইউসুফ ও শাকিলের বাবা হিসেবে চারু মিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়। অথচ তারা দুই ভাই নয়। তবে অন্য আরেকটি মামলায় শাকিলের বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে ছিদ্দিক।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আগের চেয়ে পুলিশের তদন্তের মান বেড়েছে। তবু এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের আরো তদারকি করা উচিত। বেশকিছু মাদক মামলায় দেখছি, শুধু এক শব্দে অনেকের নাম উল্লেখ করে মামলা হচ্ছে। বাবার নাম ও ঠিকানা থাকছে না। প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া সহজ।

তিনি বলেন, সঠিক পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না জানানোর ফলে আদালতও প্রায় সময় সেসব চার্জশিট গ্রহণ করেন। এভাবে প্রকৃত আসামিরা আইনের আওতায় আসছে না। মামলায় সঠিক নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হলে পরবর্তীতে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ কমে যায়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইকবাল বাহার বলেন, মাদক মামলার আসামিকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। মাদক ব্যবসায়ীদেরকে যাতে যথাযথভাবে আইনের আওতায় আনা হয়, সে লক্ষ্যে তৎপর হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
ভুল নাম,মাদক পাচার,পুলিশের ওপর হামলা,অপরাধ,চট্টগ্রাম
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist