এম.এ রউফ, সিলেট

  ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮

প্রবাসীদের অর্থ আত্মসাৎ ব্যাংক কর্মকর্তাদের

বিদেশ থেকে আসা সিলেটের প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত ৯ বছর ধরে এই টাকা সিলন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই সব ব্যাংকের কর্মকর্তারা জালিয়াতি করে মেরে দিয়েছেন বড় অংকের টাকা। ওই কর্মকর্তাদের অনেকে অভিযুক্ত, চাকরিচ্যুত হলেও ভুক্তভোগী গ্রাহকরা টাকা ফেরত পাননি। ফলে দেশের ব্যাংকের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন প্রবাসী গ্রাহকরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের এসব জালিয়াতিতে বাদ যায়নি গ্রাহকের এফডিআর করা টাকাও। গত কয়েক বছরে এ রকম হাফ ডজন জালিয়াতির ঘটনায় গ্রাহকদের প্রায় ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মামলার পর জড়িত অনেকেই গ্রেফতার হলেও টাকা উদ্ধারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরই মধ্যে অভিযুক্ত কেউ মারা গেছেন, কোনো কর্মকর্তা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, কেউবা রয়েছেন কারাগারে। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তারা বিভিন্ন উপায়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা জালিয়াতি করে ‘হজম’ করলেও ব্যাংক ওই টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

ভুক্তভোগীরা জানান, বারবার ‘আমানত খেয়ানত’ হওয়ায় সিলেটের ব্যাংকপাড়ায় যেমন অস্থিরতা চলছে, তেমনি গ্রাহকদের মধ্যে বিরাজ করছে অসন্তোষ। একাধিক জালিয়াতির ঘটনায় বিব্রত বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। সিলেটে প্রবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি। তারা দেশের এসব ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও এফডিআর করে রাখেন। এসব গ্রাহক বিদেশে থাকায় নিয়মিত আমানতের খোঁজখবর রাখতে পারেন না। এ সুযোগে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এ টাকা মেরে দিয়েছেন। প্রায়ই ঘটছে ব্যাংক জালিয়াতি ও হয়রানির ঘটনা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৯ বছরে বিদেশি সিলন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলা পুলিশ, গোয়েন্দা, দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। একাধিক কর্মকর্তাকে এরই মধ্যে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সিকিভাগ টাকাও উদ্ধার কিংবা ফেরত পাননি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কিংবা গ্রাহক। সিলেটের ব্যাংকপাড়ায় সবচেয়ে আলোচনার জন্ম দেয় সিটি ব্যাংক। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ আখলাক মিয়া ২০০৮ সালের জুলাই মাসে সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখায় ৭০ লাখ টাকার এফডিআর করেন (হিসাব নম্বর-৪১২২১৮৯৪০৫২০১)।

পরের বছর দেশে এসে ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখেন, তার টাকা ও মুনাফা (সুদ) ঠিক আছে। ২০১১ সালের অক্টোবরে আবার দেশে এসে তার এফডিআরের হিসাব জানতে ব্যাংকে যান। তাকে ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, এফডিআরের টাকা তুলে নেওয়ায় হিসাব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ খবর শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আখলাক। টাকা আত্মসাতের দায়ে বরখাস্ত করা হয় সিটি ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মুজিবুর রহমানকে। আখলাক মিয়ার ৭০ লাখ টাকার এফডিআরে সুদে-আসলে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকার মধ্যে বাধ্য হয়ে সিটি ব্যাংক ৮ কিস্তিতে ৫৭ লাখ টাকা ফিরিয়ে দেয়। বাকি ৯০ লাখ টাকা এখনো পাননি তিনি। মামলার পর আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ও যুগ্ম পরিচালক সৈয়দ তৈয়বুর রহমান বিষয়টি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেন। সিলেট দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন উপপরিচালক রেভা হালদার ওই ঘটনায় মামলাও করেন। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দুদক ম্যানেজার মুজিবুর রহমান, ক্যাশ ইনচার্জ মো. গিয়াস উদ্দিন ও সাবেক কাস্টমার সার্ভিস অফিসার মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমানকে আটক করে। বর্তমান ম্যানেজার রাব্বি কামাল চৌধুরী জানান, আদালতে মামলা চলছে। তাই বলার কিছু নেই।

বিশ্বনাথের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের ম্যানেজার ও ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোসেন আহমদ। তার সঙ্গে একই ব্যাংকে অফিসার হিসেবে ক্যাশের দায়িত্বে ছিলেন সালাউদ্দিন আহমদ। তারা দু’জন মিলে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৫ মে পর্যন্ত ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে ভাউচারে জমা নেন। পরে টাকাগুলো ব্যাংকে পোস্টিং না করে নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে বিশ্বনাথ থানায় মামলা করে।

এ ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় দুদককে। দুদক দীর্ঘ তদন্ত করে দেখতে পায় ওই সময়ে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি গ্রাহকরা জমা দিয়েছেন। কিন্তু হোসেন আহমদ ও সালাউদ্দিন আহমদ টাকাগুলো ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। দুদক ৪ এপ্রিল হোসেন আহমদকে এবং ৬ এপ্রিল নগরীর নয়াসড়ক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখা থেকে সালাহউদ্দিনকে আটক করে। তদন্ত শেষে নথিপত্র জব্দ এবং পরে মামলার চার্জশিটও প্রদান করা হয় বলে জানিয়েছেন দুদক সিলেটের উপপরিচালক তৌফিক রহমান। ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার শাখা যমুনা ব্যাংকের দুই ব্যবস্থাপক গ্রাহকদের প্রায় ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন। ২০১৬ সালে আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের শেষদিকে।

অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বরখাস্ত করা হলেও আত্মসাৎ করা টাকা পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। বরখাস্ত হওয়া ব্যবস্থাপক জাহিদুল আলম তুহিন ও মো. মোজাম্মেল হক দু’জনই আত্মগোপনে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের মধ্যে হায়দর আলীর এফডিআরের ৭৫ লাখ টাকা রয়েছে। তার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় শাখা ব্যবস্থাপক তপন ভট্টাচার্য বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলার পর দুদক তদন্ত করে দুই ব্যবস্থাপক ও এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেছে বলে জানান শাখা ব্যবস্থাপক তপন ভট্টাচার্য। তিনি জানান, বাকি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুদক ঢাকা অফিস থেকে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।

২০০৮ সালে সিলেটের ব্যাংকপাড়ার আলোচিত ঘটনা ছিল সিলন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক শিবলীর পলায়ন। তিনি গ্রাহকের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যান যুক্তরাজ্যে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মামুনুর রশীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মামলা হলে চার্জশিটে মামুনুর রশীদ অভিযুক্ত হন। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে। এ ঘটনার এক বছর পর ২০০৯ সালে উত্তরা ব্যাংক লালদীঘির পাড় শাখা থেকে ৭৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক ব্যবস্থাপক মো. লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে দুদক। তিনি ওই শাখার অ্যাকাউন্ট হোল্ডার নগরীর মিরাবাজারের নুরুজ্জামানের সঙ্গে যোগসাজশে টাকাগুলো আত্মসাৎ করেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

তবে নুরুজ্জামান মামলার তদন্তকালে মারা যাওয়ায় তাকে আসামি করা হয়নি। একই সময়ে নগরীর বেসিক ব্যাংক জিন্দাবাজার শাখা থেকে ভুয়া এফডিআরের মাধ্যমে ২ কোটি ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংকের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক পারবান চৌধুরী (মরহুম), মো. মোস্তফা কামাল ও ব্যবস্থাপক সালেহ আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সিলেটের বিভিন্ন অভিযোগ ও তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, মামলা আদালতে চলে গেলে আমাদের কিছু করার থাকে না। শুধু আদালতের নির্দেশ মতে কাজ করি। আমরা যেসব অভিযোগের তদন্ত করি তার সত্যতা পেলে ব্যাংককে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে বলি। অনেক ব্যাংক টাকা ফেরত দিয়েছে। গত কয়েক বছরে সিলেটে বড় ধরনের ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনার অধিকাংশ মামলাই আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

"পিডিএসও/তাজ

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
প্রবাসী বাংলাদেশি,ব্যাংক থেকে জালিয়াতি,অর্থ আত্মসাৎ,ব্যাংক কর্মকর্তা
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist