মো. নাজমুল সাঈদ সোহেল, চকরিয়া (কক্সবাজার)

  ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯

সাফারি পার্কে অনিয়ম, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর শিকার বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী

কক্সবাজার সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে এবং চকরিয়া উপজেলা চত্বর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটির অবস্থান। এই সাফারি পার্কে প্রতিনিয়ত অযত্ন, অবজ্ঞা আর অবহেলার কারণে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। হাতি, বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অকাল মৃত্যু এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি কয়েকটি কুমির, হরিণ মারা যাওয়ার ঘটনা তার স্পষ্ট প্রমাণ। স্থানীয় এক সংবাদকর্মী মুঠোফোনে বেড়াতে আসা পর্যটকের মাধ্যমে জানতে পারেন, পার্কের ভেতর দুটি হরিণ মরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে পৌঁছেছে এমন ছবি ও তথ্য।

এ বিষয়ে পার্কে দায়িত্বরতদের দায়ী করছে এলাকাবাসী। প্রাণী মারা যাওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাচ্ছে পার্কে দায়িত্বরত কর্মকর্তাগন। সে জন্য গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে পরিচিত কাউকে পার্কে ঢুকতে দেয়া হয় না। গত কয়েকদিন ধরে খুব কড়াকড়ি চলছে। এমনকি দর্শণার্থীদের টিকিট বিক্রিতেও খুব সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। মূলতঃ নিজেদের অপরাধ যাতে বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে, সেই লক্ষে কর্তৃপক্ষের-এমন আচরণ বলে স্থানীয়দের অভিমত। এদিকে উক্ত খবর পেয়ে চকরিয়ায় কর্মরত এক গণমাধ্যম কর্মী পার্কে ঢুকতে চাইলে বাধা দেয় দ্বায়িত্বরত গেইটম্যান। পার্কে ঢুকতে ‘উপরের নিষেধ আছে’ জানিয়ে সংবাদকর্মীকে কর্তব্যে বাধা প্রদান করা হয়। কি কারণে, কার নির্দেশে ভেতরে ঢুকা যাবেনা? জানতে চাইলে গেইটম্যান মো. ইব্রাহীম প্রতি উত্তরে বলেন, সাংবাদিক প্রবেশে মাজহার স্যারের (বিট কর্মকর্তা) নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। "ওনি এখন খুব কড়া!" বিশেষ করে পার্কের আশপাশে বসবাসরত গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর পার্কের অভ্যন্তরে প্রবেশ বেশ কড়াকড়ি।কারণ ইতোপূর্বে পার্কের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া বেশকিছু গোপনতত্ব প্রকাশ পায় স্থানীয় গনমাধ্যম কর্মীর হাত ধরে।

অবশেষে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী দর্শণার্থী সেজে টিকেট কাউন্টার থেকে নির্ধারিত মূল্যে টিকিট সংগ্রহ করে পার্কে প্রবেশ করে বিদ্যমান দৃশ্যের স্বচিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেন। পার্কে প্রবেশ করে পর্যটকের দেওয়া সংবাদের সত্যতার দেখা মিলে। দেখতে পান একটি শিশু হরিণ লেকের পানিতে মরে ভাসছে। তার পাশে একটি মাদার হরিণ বেষ্টনির সাথে গেঁথে আছে। বাতাসে পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। মরা হরিণটি অন্তত ৩/৪দিন আগের হতে পারে বলে দর্শণার্থীদের ধারণা।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গত দুই-তিন দিন পূর্বে আরো দুটি হরিণ ও একটি কুমির মারা যায়। পার্ক কর্তৃপক্ষ গোপনে মৃতদেহগুলো মাটিদে পুতে ফেলেন। সংঘবদ্ধ চোর চক্রের ধাওয়ায় পালাতে গিয়ে হরিণগুলো মারা পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বিগত কয়েক বছরে রেকর্ড সংখ্যক বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। তবু কার্যকর পদক্ষেপ নেই পার্ক নিয়ন্ত্রকদের।

নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট(নেকম) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ নজরুল ইসলাম(সুমন) বলেন, কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য অবস্থিত। এখানকার বনের প্রকৃতি হলো ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বন। ১৯৫০ সালের দিকে বন বিভাগ এখানে ১১২ সদস্যের ২টি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে এবং প্রত্যেককে ২ একর করে জমি লিজ দেওয়া হয়েছিল। এরা বন জায়গিরদার নামে পরিচিত। কালের বিবর্তনে প্রবল জনসংখ্যার চাপে, জলবায়ূ পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আগমনের ফলে বর্তমানে এ বনের উপর প্রায় ২০,০০০ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। ডুলাহাজরা সাফারী পার্ক ও মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় এ বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যটি একটি অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এখানে এলে প্রকৃতির সানিধ্য লাভ করা যায়। সুবিশাল গর্জন গাছের ছায়ায় রয়েছে নানান লতা গুলম ও প্রাকৃতিক বাঁশ ঝাড়। বুনোশুয়র, চিতা, হরিণ ইত্যাদি ছাড়াও দেখা মিলবে বুনো হাতির পাল। এগুলো সংরক্ষণের জন্য সরকার এবং এবং বিভিন্ন এনজিও কাজ করে যাচ্ছেন। তৎমধ্যে বঙ্গবন্ধু সাফারিপার্ক এশিয়ার বৃহত্তম পার্ক। এখানকার নানা প্রজাতির পশুপাখি সুষ্ঠ তদারকি যথাযথ সংরক্ষণ না হলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে।

পার্কে প্রাণীর মৃত্যুর বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের পশু হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক সহকারী ভেটিরেনারি সার্জন মোস্তাফিজুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করে রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। সাফারি পার্কের তত্ববাধায়ক রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ মোর্শেদ আলমকে প্রাণী মৃত্যুর সংবাদে ফোন করলে তার দুটি নাম্বারই বন্ধ পাওয়া যায় এবং নিজেদের আড়াল করে রাখেন। যার ফলে পার্কে প্রাণীর মৃত্যুর সঠিক তথ্য নেওয়া যায়নি।

উপরোক্ত বিষয়ে জানতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বরত ডিএফও আবু নাছের মোঃ ইয়াসিন নেওয়াজকে মুঠোফোনে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ঘটনাটি যত দ্রুত সম্ভব একটি তদন্ত টিম গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান। সাফারী পার্কে ইতোপূর্বে তিনটি বাঘের শাবক, হাতি, বাঘ, কুমির, জেব্রা, হরিণসহ এভাবে একেরপর এক জীবজন্তু ও পশুপাখী মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

পিডিএসও/রি.মা

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
সাফারি পার্ক,অনিয়ম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close