ফকির ইলিয়াস

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

কবিতায় বিজয়ের মুক্তিস্বর

মার্কিন কবি জেমস টেট বলেছিলেন, ‘আগুনের কুন্ডলীগুলো আমরা দেখি। কিন্তু কে দিয়াশলাই দিয়ে দিয়েছে আগুন, তাকে আমরা দেখি না। তার খোঁজও রাখি না। অথচ এই ছাপাক্ষরের মতো যে সবুজ আমরা দেখিÑ তার বীজ কেউ তো বপন করে গিয়েছিলেন।’

কবির এই কথাগুলো যেকোনো রাষ্ট্রিক, ভাষিক মানুষের ক্ষেত্রেই খাটে। একটি দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্রÑপাওয়াটা বিশ্বের অনেক মানুষের কাছে এখনো স্বপ্ন। বাংলাদেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য একাত্তর সালটি ছিল একটি ঐতিহাসিক বছর। এই সময়টিতে এই ভূখন্ডের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। রক্তে রক্তে ভেসে গিয়েছিল এই বদ্বীপ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। কবিরা তাদের কবিতায় তুলে এনেছেন সেই শহীদদের কথা, সেই ঋণের কথা। যা একজন মানুষের; তার মাটির প্রতি অবনত শ্রদ্ধা।

বাংলাদেশের বিজয়ের বয়স ৪৬ বছর। এই সময়ে এই দেশ কী পেয়েছে, কী করেছে, কী করতে পারেনিÑ এমন অনেক কথাই উঠে এসেছে আমাদের সমকালীন কবিতায়।

একাত্তর যারা দেখেছেন, সেসব কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় আমরা একাত্তরের চিত্র দেখেছি খুব স্পষ্টভাবে। এরপরের বাংলাদেশের কথাও আসছে, এসেছে আমাদের কবির কবিতায়। মোহাম্মদ সাদিক আমাদের সময়ের একজন উজ্জ্বল কবি। পড়া যাক তার একটি কবিতাÑ

‘তিনি পাঞ্জাবি পরতেন, তার ওপর/খদ্দরের মুজিবকোট, মুখে এক চিলতে হাসি/জোছনার মতো,/দেখা হলেই বলতেনÑ ‘এসো-পথে এসো’/যেন অন্য সবাই পথ হারিয়েছে নবকুমারের মতো/যেন অন্য সবাই অন্ধকারে/এবং তিনি বাতিওয়ালা, ঘরে ঘরে রাস্তায়/তিনি বাতি জ্বালাবেন সারারাত/পাখি তিনি, প্রতিদিন সকালে শিস দিয়ে/সকলকে সংবর্ধনা দেবেন।/একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর সকালে/তাঁর হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া গেল/দেখার হাওরের পাঁজরের পাশে/পথপ্রদর্শক, বাতিওয়ালা কিংবা পাখি/বাংলাদেশ কাউকেই মনে রাখেনি।

[মুক্তিযোদ্ধা তালেবের পথ/মোহাম্মদ সাদিক]

এই ঘটনা বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসের অংশ। আমরা কি মনে রেখেছি আমাদের সূর্যসন্তানদের! কতটুকু রেখেছি! তারপরও আমাদের ভরসা আমাদের তরুণ কবিরা। আমাদের জাগরণের দীপশিখা যারা বহন করে যাবেন যুগের পর যুগ।

দুই.

একটি তরুণ প্রজন্মের হাতেই যুগে যুগে রক্তিত হয় একটি দেশের স্বাধীনতা, বিজয়। তারা পড়েন, তারা লিখেন। উদ্ভাবন করেন নতুন করে শক্তি ও সাহসের তারাগুলো। এভাবেই সংগ্রামী উচ্চারণে একজন বাঙালি কবি লিখে রাখেনÑ

‘জীবনচর্যার ঘাটে ঘাটে প্রদীপ সাজাই। দীপাবলীর গন্ধ ওঠে বিমূর্ত রাগানুগা ক্যানভাসে। আমার ষোড়শ পূর্বপুরুষের ভালোবাসায় পুনশ্চ আরও একবার স্নিগ্ধ হয়ে ওঠেন পূর্বনারীদের আবহমান সহসংগ্রামের বিজয়গাথা। এভাবেই অজানা আলোর মতো বাঁচতে শিখি। গুহালিপির মধ্যে থেকেই বেছে নিতে শিখি প্রেমোপাখ্যান। অক্ষরলিপি থেকে শব্দ চিনতে শিখি। একটি জীবনভিত্তিক পাঠ বিশ্লেষণ চলে সময় মেপে দ্রুত বেগে। যে সমস্ত নেতিবাচক ইতিবৃত্ত ঘুরে চলে শিরায় শিরায় তার মুখে পা ঘষে জানিয়ে দিতে চাই আমার অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্বের দাগ। বুঝতে শিখি দাঁতে দাঁত চেপে। সমস্ত হেরে যাওয়ার মানে কখনও পুরো হেরে যাওয়া নয়...।’

[একটি হেরে যাওয়া মানুষের কিছু কথা/অভিজিৎ পাল]

একাত্তর আমাদের চেতনার উৎস। আমাদের কাব্যসম্ভারের বহুমাত্রিক দ্যোতনা। স্মৃতির পাখনায় ভর করে যে মনপাখি প্রতিদিন উড়ে যায়Ñ কবি তারই প্রতিভূ হয়ে নিজেকে সাজান। বাজিয়ে যান আপন একতারা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও সৌন্দর্য, প্রত্যয় ও শক্তি, রক্তমূল্য এবং অনিবার্যতা বিচিত্র অভিব্যক্তিতে উদ্ভাসিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল কবিসহ নবীন-প্রবীণ প্রায় সব কবির কবিতাতেই। আসুন পড়ি একজন তরুণ কবির স্মৃতিকণ্ঠÑ

‘তবে আগুন দেখলেই মনে পড়ে/ঘোষপাড়ার আকাশ ছোঁয়া/লেলিহান শিখা, মানুষের আর্তনাদ/ভয়ার্ত পাখির উড়াউড়ি/এক কাপড়ে আমাদের ঘরে আশ্রয়/নেয়া মাধুরীদি, একসঙ্গে/বেড়ে উঠা প্রিয়বন্ধু ধীরেন এর কথা।/মাধুরীদি আজ আর নেই/আছে রাজেন আছে স্মৃতিসাক্ষী/সেদিনই প্রথম দেখেছিল সে পৃথিবীর মুখ।/স্বাধীনতার মতো তাঁরও বাড়ছে বয়স/দেশের যেমন বাড়ছে বোঝা/তাঁর বাড়ছে অভাব, বাড়ছে প্রশ্ন/বাড়ছে ক্ষত।’

[বাড়ছে বয়স বাড়ছে ক্ষত/আহমেদ ছহুল]

ডিসেম্বর মাসে বাংলা সেজে উঠে এক অপরূপ সাজে। এই সময়টি শীতকাল বিধায় প্রাকৃতিক নান্দনিকতা সকল মানুষকেই করে তোলে ভাবুক। জারি, সারি, মারফতি, মুর্শিদি গানের লীলাভূমি বাংলার মাঠগুলোতে রাতের পর রাত বাউলরা যে গানের আসর বসান, তাও আমাদেরই বিজয় বন্দনা।

অসীম আত্মত্যাগ ও মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বিজয়। আবহমান কালের বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বপ্ন আর সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সেই বিজয়কে ধারণ করেছেন আমাদের কবিরা।

‘বাংলা আমার শ্যামল-শোভা/ধান-সবুজের দেশ,/বন-বাদাড়ে নিবিড় ছায়া/চোখ জুড়ান বেশ।/সকাল সাঁঝে নিত্য মুখর/পাখির কলরব,/বাংলা আমার জন্মভূমি/স্বাধীন-মুক্ত সব।/রক্ত-সাগর পাড়ি দিয়ে/ন’মাস লড়াই করে;/বাংলাদেশটা স্বাধীন পেলাম/ষোলই ডিসেম্বরে।

[ষোলই ডিসেম্বর/মালেক ইমতিয়াজ]

যে কথাটি না বললেই নয়, তাহলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে। মানবতাই ছিল আমাদের মূলমন্ত্র। আমি দেখি, এই সময়ের কবিরা সেই চেতনাই উড্ডীন করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সামাজিক, কাব্যিক, অর্থনৈতিক, সকল উন্নয়নের সাথী সকল ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ। আর এটাই ছিল একাত্তরের মূল চেতনা। মনে রাখা দরকার, ব্যক্তির অনুভব ও বোধ একাত্ম হয়েই নির্মিত হয় সামাজিক অনুভব ও বোধ। কবিতায় প্রকাশিত অনুভূতি ব্যক্তি কবির হলেও তা দেশ ও জাতির পাঁজরের সাথেই সম্পৃক্ত হয়ে যায়। গেঁথে থাকে পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপটে। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা আমাদের ইতিহাস পড়িয়েছে। একই সাথে সমকালের সংকট ও প্রত্যয়কে তুলে ধরেছে।

‘শাদা মাটির গল্প/আর শেষে পরীবাগ পার হয়ে/এমনি করেই বসন্ত বরণ/লুনা ছিলো চাকমা মেয়েটির নাম/এবং অজানা কোনও পঙক্তি/পাঠের মতো সকলের অনুভূতি/

হাস্যরোল/আর কলমের নীচ থেকে/মাত্রা ঘেরা অক্ষর, ছবি বদল/ভায়োলিনে কে বেশি উন্মুক্ত/এ রকম করে করে/এখনো পরীবাগ পার হয়ে/ঠিকই দাঁড়িয়ে আছো/সদা হাস্যরোল/কোলাহলমুখর বা সেই যে/অনুভূতি নিয়ে/দাঁড়িয়ে থাকা এখনো/যে মেয়েটি শাহবাগ;/সবুজ সঙ্কেতে ঘিরে থাকা/তুমুল মহানগর।’

[লুনা ছিলো চাকমা মেয়েটির নাম/রাজীব আর্জুনি]

আজ জাতির পিতার সেই অমর সাতই মার্চের ভাষণটি নিয়ে গোটা বিশ্ব কথা বলছে। জাতির পিতার কীর্তি নিয়ে লেখা হচ্ছে অসংখ্য কবিতা-গান। তার ভাষণকে নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ লেখেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি। ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলাÑ/কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি;/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কবিতা এভাবেই ধারণ করেছে ১৯৭১-কে। ধারণ করেছে অনলের লেলিহান শিখায় পোড়ে যাওয়া গ্রামের দৃশ্য। এই সময়ের একজন কবির বর্ণনায় শোনা যাক সেসব কথা।

‘আড্ডার মুখোমুখি যে গোলাপ, তার গায়ের/বৃষ্টির দাগগুলো সনাক্ত করি। কিছু বসন্ত/বিগত হয়েছে। কিছু বৈশাখ আসার আগেই/আক্রান্ত হয়েছে হাওর পারের মানুষ। একটি/পাখির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে কাঁদছে,/হাকালুকির অভিন্ন সত্তা।/এই হাওরপারে একদিন আমার বসতি ছিল।/এই জলের স্পর্শে স্পর্শে আমাকে একদিন/জাগাতো শালুকগন্ধা ভোর। ঘুমচোখÑ/মুছে মুছে আমি দেখতাম,/ ঢেউ কাঁপছে-ছায়া নড়ছে।/অগণিত মানুষের ছায়া আজ পরিত্যক্ত/দাগে দাগে মিশে গেছে। অসংখ্য স্বপ্ন,/কেবলই উঁকি দিচ্ছে বাণের অন্তরালেÑ/আবার জীবনের সমান্তরালে ফিরবে বলে।’

[পরিত্যক্ত বৃষ্টির দাগ/ফারহানা ইলিয়াস তুলি]

কবিতা একটি জীবনবাদী শিল্পমাধ্যম। কবিতাই মানুষকে অনেকক্ষণ ধরে তন্ময় করে রাখতে পারে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কবিতাগুলো সেই সাক্ষ্য বহন করেই চলেছে। যত দিন যাবে, নতুন কবির হাতে লিখিত হবে নতুন চিত্রকল্পে, নতুন অনুপ্রাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। আর আমাদের অগ্রজ কবিদের লিখে রাখা পঙক্তিমালাই থেকে যাবে তরুণদের পাথেয় হয়ে।

‘তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ/তোমার মেশিনগানের ম্যাগাজিনে ৪৫টি গোলাপের কুঁড়ি/তুমি ক্যামোফ্লেজ করলেই মরা ঝোঁপে ফোটে লাল ফুল/দস্যুরা অস্ত্রকে নয় গোলাপকেই ভয় পায় বেশি/তুমি পা রাখলেই অকস্মাৎ ধ্বংস হয় শত্রুর কংক্রিট ব্যাংকার/তুমি ট্রিগারে আঙুল রাখতেই মায়াবীর মতো জাদুবলে/

পতন ঘটে শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ঢাকা নগরীর/তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসা/সর্বাঙ্গে তোমার প্রেম দাউদাউ জ্বলে/তুমি পা রাখতেই প্রেমিকার ব্যাকুল দেহের মতো যশোর কুমিল্লা ঢাকা/অত্যন্ত সহজে আসে তোমার বলিষ্ঠ বাহুপাশে/তোমাকে দেখলেই উঁচু দালানের শির থেকে/ছিঁড়ে পড়ে চানতারা মার্কা বেইমান পতাকা/তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে জীবন/তুমি দাও থরো থরো দীপ্ত প্রাণ বেয়নেটে নিহত লাশকে/তোমার আগমনে প্রাণ পায় মরাগাছ পোড়া প্রজাপতি/তোমার পায়ের শব্দে বাংলাদেশে ঘনায় ফাগুন/৫৬,০০০ বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগানে/এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল

[মুক্তিবাহিনীর জন্যে/ হুমায়ুন আজাদ]

প্রজন্ম যুগে যুগে কবিতার পক্ষে দাঁড়াবে। দাঁড়াবে মানবতার পক্ষে। আর মানবতাবাদই প্রকৃত বিজয়। মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়াই একটি জীবনের শেষ দায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist