তাঈদ উদ্দিন খান

  ১৫ মার্চ, ২০২৪

বই আলোচনা : হাবিবুর রহমানের অনন্য গবেষণা

ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা

‘ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা আগেই পড়েছি। সমকালের একটি ব্যতিক্রমী বই- এমন কথাও অনেকে লিখেছেন। কনটেন্ট, প্রচ্ছদ, মেকআপ সব মিলিয়েই বইটি ব্যতিক্রমী।

নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাগি টলারম্যানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শুরু করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে মানুষই হলো একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা আছে, এই ভাষার কারণে আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা হয়েছি।’ বিশ্বে কয়েক হাজার ভাষা বিদ্যমান। চীনা ম্যান্ডারিন ভাষায় ১০০ কোটি মানুষ কথা বলে। অন্যদিকে বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা ঠার ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র চল্লিশ হাজারের মতো। লেখক হাবিবুর রহমান এরকম একটি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন যার কোনো লিপি নেই। আবার ভাষাটি পৃথিবীর প্রধানতম ভাষা পরিবার ইন্দো-ইউরোপীয় গোত্রেরও নয়।

৩৬৮ পৃষ্ঠার বিশাল এই বইটিতে এগারোটি অধ্যায় রয়েছে। রয়েছে ২২টি পরিচ্ছেদ। গবেষণার মেথডলজি মেনেই অধ্যায়গুলো অগ্রসর হয়েছে। শুরুতেই ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কিকে ঘিরে লেখকের মুগ্ধতার চিত্র ফুটে উঠেছে।

বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা যেমন ঠার, তেমনি ঋষি বা মুচি সম্প্রদায়ের ভাষাও ঠার। অন্ত্যজ শ্রেণির এই জনগোষ্ঠীর ভাষার সাথে অবশ্য বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার কোনো মিলই নেই। যেহেতু বেদে সম্প্রদায়ের ভাষার কোনো লিপি নেই তাই এই ভাষাকে কেউ কেউ সাংকেতিক ভাষা বা ‘অপার্থ ভাষা’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তবে ভাষাবিজ্ঞানী সুকুমার সেন বলেন, ‘গোপনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে দলের লোকের কাছে প্রকাশ্যে অন্যের অবোধ্য অথচ প্রয়োজনীয় সংলাপ স্বাভাবিকভাবে চালাইবার জন্য বিশেষ বিশেষ (এক বা একাধিক ভাষা হতে গৃহীত) শব্দ বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এ রকম বাগ ব্যবহারকে অপার্থ-ভাষা অথবা সংকেত-ভাষা বলা হয়।’

অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলে বেদে জনগোষ্ঠীকে অপরাধপ্রবণ হিসেবে সনাক্ত করা হয়েছিলো। আজও জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এরা যে কোনো অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে।

লেখক হাবিবুর রহমান বইয়ের ভূমিকায় জানাচ্ছেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে বেদেরা নৌকাকেন্দ্রিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। গত কয়েক দশকে দেশে সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় ও নদী-নালার নাব্য কমে যাওয়ার ফলে তাদের জীবনব্যবস্থাও পাল্টে যাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন সহজলভ্যতা ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারে বেদে জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষের তথাকথিত তাবিজ-কবজ ও ভেষজ চিকিৎসা পেশা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। জীবিকার তাগিদে তারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। সাপের ঝাঁপি নিয়ে চলে যায় টেকনাফ, ফিরে আসে ইয়াবা নিয়ে।’

এই অংশটুকু গুরুত্বপূর্ণ। লেখক যখন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন তখন তিনি প্রথম বিষয়টি আঁচ করতে পারেন এবং তাদের অপরাধপ্রবণ মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে সংকল্পবদ্ধ হন।

বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখকই বেদে জনগোষ্ঠীকে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন। পল্লীকবি জসিম উদ্দীন লিখেছেন নাটিকা ‘বেদের মেয়ে’। কবি নজরুল লিখেছেন কয়েকটি গান। তারাশংকর লিখেছেন ছোটগল্প ‘বেদেনী’। তোজাম্মেল হক বকুল বানিয়েছেন চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। এটি বাংলাদেশের সর্বকালের ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে চিহ্নিত। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে অন্যতম একটি রাগ ‘মালকোষ’। বেদে সম্প্রদায়ের সুর থেকে এই রাগটির উৎপত্তি বলে কোনো কোনো সঙ্গীত গবেষক মনে করেন। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বেদেনী’ গল্পে লিখেছেন, ‘রাধিকার চোখ দুইটি হিংস্রভাবে যেন জ্বলিতেছিল। শম্ভু নিকটেই একটা গাছতলায় নামাজ পড়িতেছিল; আরও একটু দূরে আর একটা গাছের পাশে নামাজ পড়িতেছিল কিষ্টো। বিচিত্র জাত বেদেরা। জাতি জিজ্ঞাসা করিলে বলে, বেদে। তবে ধর্মে ইসলাম। আচারে পুরা হিন্দু, মনসাপূজা করে, মঙ্গলচণ্ডী, যষ্ঠীর ব্রত করে, কালী দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করে, নাম রাখে শম্ভু শিব কৃষ্ণ হরি, কালী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী। হিন্দু পুরাণ কথা ইহাদের কণ্ঠস্থ। এমনই আরো একটি সম্প্রদায় পট দেখাইয়া হিন্দু পৌরাণিক গান করে, তাহারা নিজেদের বলে পটুয়া, পট তাহারা নিজেরাই আঁকে। বিবাহ আদান প্রদান সমগ্রভাবে ইসলাম ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে হয় না, নিজেদের এই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বিবাহ হয় মোল্লার নিকট ইসলামীয় পদ্ধতিতে, মরিলে পোড়ায় না, কবর দেয়।’ কথাসাহিত্যের সম্রাট তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে অল্প কথায় বেদে-সংস্কৃতির গোটা আখ্যান রচনা করেছেন বলে আমাদের মনে হয়।

বেদে সম্প্রদায়ের গান এমং মন্ত্র নিয়ে বিভেদ আছে। কোনটা গান আর কোনটা মন্ত্র খুব কাছ থেকে খেয়াল না করলে বোঝার উপায় নেই। যেমন সাপের বিষ নামানোর যে মন্ত্র সেটিকে বেদেনীরা গানের সুরে সুরে প্রকাশ করে। যেমন, ‘কার আঁচলে থাকারি বিষ/আমার আঁচলে থাক।/আমার আঁচল থাকিয়া যদি/অন্য আঁচলে যাস/দোহাই লাগে মা-মনসার/মাথা খাস।’ (দ্রষ্টব্য লোক গবেষক সুমনকুমার দাশ বিরচিত গ্রন্থ)

প্রতিটি মন্ত্র এবং গানের একটি অংশে দোহাই বা চ্যালেঞ্জ থাকা বেদে গানের রীতি। ‘আমার আঁচল থাকিয়া যদি/অন্য আঁচলে যাস/দোহাই লাগে মা-মনসার/মাথা খাস’- এই অংশটুকু দোহাই নামে স্বীকৃত। ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ গ্রন্থে এরকম একটি অধ্যায় সংযোজনের দাবি রাখে যার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বেদে সম্প্রদায়ের উপস্থিতির কথা পাঠক মহল অবগত হতে পারেন।

লেখক-গবেষক হাবিবুর রহমানের গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত তথ্যসমূহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গবেষণায় ভবিষ্যতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আমরা জানি যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে খুব বেশি কাজ বাংলা ভাষায় হয়নি। গারো ও চাকমাদের নিয়ে কিছু কাজ অতীতে হয়েছে। বইটি পাঠের পর মনে হয়েছে লেখক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষকদের জন্য চিন্তাসূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন। বইটি এরই মধ্যে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভারতের এপিজে আব্দুল কালাম পদক এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০২৩-এর মধ্যে অন্যতম। শেষের পুরস্কারটি তুলে দিয়েছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই বইয়ে বেশ কিছু কার্যকর তথ্য ও সূত্র আছে। কয়েকটি উল্লেখ করছি-

ক. ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ভাষা জরিপ সংস্থা এথনোলগের চব্বিশতম প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমান পৃথিবীতে মোট প্রচলিত ভাষার সংখ্যা সাত হাজার ১৩৯টি। খ. পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী মানুষ ২৩টি ভাষায় কথা বলে। গ. সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা ১২টি। চীনা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, স্প্যানিশ, আরবি, পর্তুগিজ, রুশ, বাংলা, জাপানি, জার্মান ও ফরাসি। ঘ. এই ১২টি প্রধান ভাষাই ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য। ঙ. বর্তমান পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনিতে সবচে বেশি ভাষাভাষী মানুষ বাস করে। ইন্দোনেশিয়ায় ৬৭০টি ভাষা এবং পাপুয়া নিউগিনিতে ৮৫০টি ভাষা প্রচলিত। চ. পৃথিবীতে প্রতি ১৫ দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। ছ. ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা নিয়ে সর্বশেষ জরিপভিত্তিক প্রকাশনা বের হয়েছিলো প্রায় ১০০ বছর আগে, ১৯২৮ সালে। নাম Linguistic Survey of India. জ. বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও আরো প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষা প্রচলিত আছে। ঝ. বাংলাদেশের আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায় যে ৬৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বাংলা ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষা ব্যবহার করে আসছে এবং ঞ. বাংলার পর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রধান প্রধান ভাষা : চাকমা, মারমা এবং হাজং। চাকমা ও হাজং ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা পরিবারের হলেও, মারমা ভাষাটি তিব্বতি-বর্মি গোত্রের। হাজং ভাষার লিপি না থাকলেও বাকি দুটো ভাষার লিপি আছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close