জান্নাতুন নিসা

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

রাজৈশ্বর্য্যরে মতো চিত্রিত আসাদ চৌধুরীর গদ্যের ধারাপাত

অমর যত্নের অনিন্দ্য উচ্ছ্বাস আর খেতাবি বৈচিত্র্যের দোলায়িত ছায়াসঙ্গী হয়ে বাঙালি জীবনযাত্রার পরতে পরতে মৃদু হাসিতে পথ হেঁটেছেন যিনি। শূন্যগর্ভতায় লীন হয়ে এগিয়ে আসা চিন্তার কপাট খুলে স্বীয় কলমে যিনি গড়ে তুলেছেন আপন ভাষা। পাঠক তার সেই অনন্য লেখনীর ভাষাপূর্ণ অভিধানে স্থির ভঙ্গির নাম দিয়েছে কবিতা। তিনি আমাদের অতি আপনজন- কবি আসাদ চৌধুরী। বাঙালি জীবনে প্রোথিত সত্যানুসন্ধ্যানের যাবতীয় হতাশার অজ্ঞতায় রপ্ত তুকতাক বিপ্লবের আঁধার ভুবনে তিনি চোখ রেখেছেন। আর ত্রিশোত্তর গরিষ্ঠ আবিষ্কারের ক্লান্ত চোখে তিনি বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তুর হাত ধরে লঘিষ্ঠ রোশনাই জ্বেলেছেন অতি সন্তর্পণে। আমরা বাংলা কবিতায় বাঙালি সংস্কৃতির আলোকিত ধারক ও বাহক হিসেবে পেয়েছি কবি আসাদ চৌধুরীকে। তবে তার কবিতার খাতাজুড়ে রুপালি জোছনার আলপথ তৈরি করলেও তিনি প্রয়োজনের সওদায় গদ্য রচনায় ভেজা বিহঙ্গের সঙ্গে আত্মীয়তা করেছেন অনন্য ব্যঞ্জনায়। আর তাই হয়তো- বিদীর্ণ পরিপার্শ্বের স্বাতন্ত্র্য তৎপরতায় নাগরিক ভঙ্গির লোকায়ত ঐক্য গড়তে অব্যর্থ বয়ানে নিজেকে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যে দাঁড় করিয়েছেন আসাদ চৌধুরী। কবি নামে যার ভিন্ন অথচ অনবদ্য চিত্রায়ণ প্রজন্মের খোলাপাতায় যূথীবনের ন্যায় পরানে পরান মিলিয়ে গাল-গপ্পো করে শুক্লা দ্বাদশীর সন্ধ্যায়। আর ব্যাকুল শতাব্দীর সীমানায় জেগে থাকা আসন্ন আমাবস্যার নীরবতা দূরে ঠেলে ধ্যানমগ্ন হয় কোজাগরীর নিকোনো উঠোন জুড়ে। আবার লেখনীর সাধনার উত্তম আরাধনায় একেবারে অনেকটাই বলা চলে স্বীয় তপস্যাবলে পাঠকের মননে গদ্যের রণরণি তুলে দিয়েছেন তার হৃদয়তন্ত্রীতে বয়ে যাওয়া মন্ত্রের মহা-ওঙ্কারধ্বনিতে। পাঠকও তার গদ্যের সহজাত সারল্য, মৃদু অথচ দৃঢ় সাবলীলতাকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে অমীয়সুধারূপে চুম্বন করেছে। আঁকড়ে ধরেছে পাঠসরস শব্দবন্ধের শেকড় সন্ধ্যানী আশা জাগানিয়া রতনরূপে।

বাঙালি সংস্কৃতির লোকবিশ্বাস থেকে লোকসংস্কারে, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্যে, জাতীয়তাবোধের ঐক্য থেকে স্বাধীনতাকামী জনতার অব্যর্থ গন্তব্যের নিত্য লড়াইয়ের সারথি হয়ে আসাদ চৌধুরী গদ্যের চিত্রায়ণ করেছেন অনবদ্য ভঙ্গিমায়। আর তাই বলা চলে পরিকল্পনার ইপ্সিত ফলের ওমে আমরা তার গদ্যে পেয়েছি সোনালি স্মৃতির তীক্ষè গাথা। যাবতীয় বিরোধিতার প্রসঙ্গ গুটিয়ে তিনি দ্রোহের সুঁচে গেঁথেছেন অর্জনের মালা, তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। ভাঙাচোরা কল্যাণের মিহি গতির আভিজাত্যে তিনি সাদামাটা ভাষায় গদ্যের শৌখিন সুরভী ছড়িয়েছেন আপন মহিমায়। তার গদ্যে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন কৌলিণ্যছোঁয়া বীর বাঙালির প্রকৃতির বুকে ফুটে ওঠা বিজয়ের শিল্পিত কেরামতি। গদ্যভারেপূর্ণ লেখকের সঙ্গে পাঠকের বিশ্লেষণাত্মক দূরত্বকে তিনি বাড়ন্ত অনুসন্ধানকালের ঔদার্যে নির্ণয় করেছেন অপরিমিতস্বরে। সংজ্ঞায়িত প্রসন্নতালাভের নিছক প্রয়াসে তিনি গদ্যকে ভারী নয়, বরং চর্চিত অর্ঘ্যরে সরলতম রূপায়ণ করেছেন। করেছেন খেয়ালি নিখুঁতের কালো মেঘহারা জ্যোতির্ময় পর্যালোচনা। লেখনীর দায়িত্বের প্রবল আসক্তিতে অপার সম্ভাবনার আলো ফুটিয়েছেন গদ্যের শরীরে। গদ্যপাঠের আকর্ষণে পাঠক এ ক্ষেত্রে খুঁজে পাবে মৌলিক সংক্রমণ। তার গদ্যপাঠে আমরা পাঠসংক্রমণে আসক্ত হব, তার লেখনীর সাবলীলতায় খুঁজে পাব তেজোদ্দীপ্ত স্মৃতির সমাহার।

পাঠকের ভালোবাসায় পদ্যবীণার ঘাটে আসাদ চৌধুরীর গদ্য দৃশ্যতই নেহাত কম নয়। এমনই দৃশ্যমান অদৃশ্যের ঘেরাটোপে ডুবে থাকা বাস্তবতাকে তিনি গদ্যের গাঁথুনিতে অনন্য করেছেন। জীর্ণ পারিজাতের অধরা আঘাত আমাদের কতটা প্রলুব্ধ করে তা তিনি দেখিয়েছেন তার গদ্যের নিপুণ আঘাতে। সমাজে লুকিয়ে থাকা কৌশলভিত্তিক নীরব অপতৎপরতা এবং আগ্রাসন আমাদের বাঙালি জীবনে কতটা বেদনার তা পাঠক খুঁজে পাবে তার গদ্যে। খুঁজে পাবে টলমলে বঞ্চনার নিরুত্তরে জানালা গলে ঠিকরে ওঠা স্বদেশি বায়নায় পাওয়া ভিনদেশি আলো। তবে তার গদ্যে পাঠক আরো খুঁজে পাবে অনাহত জলধারার তীব্র কলস্বরে বেজে ওঠা সন্ধ্যাগগন আকুলকরা ধ্বনি, যা প্রতিধ্বনিত হবে যুগের ঝলমলে বৈঠকখানায়। আর সময়ের যতনে হয়ে উঠবে ভাঁজখোলা রোদ্দুর।

গদ্যের পরম্পরায় স্বর্গীয় দৃষ্টান্তে স্নাত সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে আসাদ চৌধুরী পাঠ মেলাননি। তিনি পাঠ মিলিয়েছেন বিচ্ছিন্ন ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতায়পূর্ণ মানবমনের অসীম বাস্তবতায়। তাই তো লোকায়ত আর নাগরিকতায় তার গদ্য পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছে শেকল ভাঙার অসামান্য প্রতীক্ষা। যেখানে নক্ষত্রের রুমালে তিনি অঙ্কন করেছেন শাশ্বত বাঙালিয়ানার সবুজের অবুঝ দৃশ্যপট। স্পষ্ট করেছেন আলোকিত সাধনার অর্পিত সংস্কার। তার গদ্যে তিনি আরো দেখিয়েছেন মানব অবলম্বনের দৃঢ় ভাবমূর্তির। যেখানে ডানা ঝাপটায় ব্যামোর পৃথিবীজয়ী সরল বিশ্বাসেপূর্ণ দখলী নিঃশ্বাস। তাই তো বাঙালি জীবনের সংস্কৃতি, আন্দোলন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা সর্বোপরি প্রতিটি সুপ্ত এবং প্রস্ফুটিত আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ, দৃঢ় ও নমনীয় তান রাজৈশ্বর্য্যরে মতো চিত্রিত হয়ে আছে আসাদ চৌধুরীর গদ্যের ধারাপাতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close