সোহেল নওরোজ

  ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

বইমেলা, বই পড়া ও বিবিধ ধারণা

বই কী করে? বই পড়লে কী হয়? কীভাবে বোঝা যায় একটা প্রজন্ম বই পড়ছে?- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস এ নিবন্ধে

একটা সুন্দর সময়ের জন্য কী চাই?- আপনাকে যদি এ প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়, উত্তরটা কী হবে? একেকজনের জবাব একেক রকম হবে, সেটা নিশ্চিত। স্মার্টফোন, দামি গাড়ি, সুন্দর একজন সঙ্গী ইত্যাদি সব বিষয় উঠে আসবে। অথচ বিশ্বের অনেক মানুষ আছে, যাদের কাছে প্রশ্নটা রাখলে উত্তর আসবে- বই। আমাদের বেশির ভাগই বইকে প্রয়োজনীয় মনে করলেও অপরিহার্য মনে করি না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে ‘বোঝা’ মনে করি, একটা বই কেনার চেয়ে অন্যকিছুর পেছনে অর্থ ব্যয় করাকে ‘বুদ্ধিমানের কাজ’ বলে জ্ঞান করি, ক্ষেত্রবিশেষে বই পড়াকে তাচ্ছিল্যও করা হয়। অথচ বই পড়াকে অত্যাবশ্যকীয় মনে করে, নিয়ম করে বই পড়ে এমন মানুষের কমতি নেই। আমাদের এ বাংলা ভূভাগেও একসময় বই পড়ে বিনোদিত হতো সিংহভাগ মানুষ। তখন অবশ্য হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না। বিনোদনের নামে সস্তা ও রুচিহীন উপকরণের আধিক্য ছিল না। পাড়ায়-মহল্লায় পাঠাগার ছিল। বাড়িতে বই পড়াকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। বন্ধুর বই পড়াকে হেয় জ্ঞান করা হতো না। বরং তারাই বাহ্বা পেত।

ওপরের অংশটুকু পড়ে প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কি মানুষ এখন বই পড়ে না? প্রতি বছর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ও বই বিক্রির পরিমাণ ধর্তব্যে নিলে বলতেই হয়- আগের চেয়ে বইয়ের বাজার অনেক গুণ প্রসারিত হয়েছে। মানুষ বই কিনছে বেশি। সশরীরে নেড়েচেড়ে, পৃষ্ঠা উল্টে গন্ধ শুকে যেমন কিনছে, তেমনি কিনছে অনলাইন বুকশপ থেকেও। বই কেনা পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও পড়ার ক্ষেত্রে আমরা বোধহয় আগের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছি। একটা বই যতটুকু সময় আর মনোযোগ দাবি করে, তার কতটুকু দিতে পারছি?

বইয়ের প্রতি আমাদের অনুরাগ নিয়ে প্রশ্ন নেই। নিয়ম করে ফি বছর বইয়ের মেলা হয়। যেনতেন মেলা নয়, বিশালায়তনের মেলা। বাংলা একাডেমি পরিসর বাড়াতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শরণাপন্ন হয়েছে। তাতেও ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষ বিশেষ দিনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সব ধরনের মানুষ। গল্প, আড্ডা, ছবি তোলা, অটোগ্রাফ নেওয়া-দেওয়া সবই চলে। বইয়ের কাটতিও হয় ঢের। ফেসবুক ফেব্রুয়ারিতে বইময় হয়ে ওঠে। দেখতে বেশ লাগে। তার পরও কিছু একটা কমতি যেন অনুভূত হয় গোপনে। বই আর ১০টা পণ্যের মতো হলে এমনটা হতো না। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তো ধরা, ছোঁয়া বা ব্যবহারের নয়; আত্মার। সেই সম্পর্কের সুতোটা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে না তো! আমাদের পঠন, শিখন এবং বাস্তব জীবনে প্রায়োগিক মাধ্যম বই কি আগের মতো শক্তপোক্ত ভূমিকা রাখতে পারছে? প্রশ্নটা নির্দিষ্ট কারো জন্য নয়, যার যার নিজের কাছে করাই যায়।

বই কী করে? বই পড়লে কী হয়? কীভাবে বোঝা যায় একটা প্রজন্ম বই পড়ছে?- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস পাওয়া যাক। বই পড়ার গুরুত্ব নিয়ে আজ অবধি বিস্তর আলোচনা, গবেষণা হয়েছে। মোটামুটি সবারই মত, শারীরিক সুস্থতার মতো মানসিক সুস্থতার জন্য বই পড়া অপরিহার্য। বই এমন একটি শক্তি যা একজন মানুষকে আলোকিত করে। বই মানুষের ভেতরের সব অজ্ঞানতা দূর করে জ্ঞানের আলো প্রজ্বালিত করে এবং একবার যার ভেতর এই আলো প্রজ্বালিত হয়, সাধারণত সে আর কখনোই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় না। বই পড়ার এটাই সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক। বই আমাদের শুধু নতুন কিছু জানতে সাহায্য করে তা নয়, বরং বই আমাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি করে। বই মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। বই আমাদের নতুন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। একজন মানুষ যখন বই পড়ে, তখন সে লেখকের চিন্তার সঙ্গে মিশে যায়। বইয়ের কাহিনি বা চরিত্রের সঙ্গে পাঠক নিজের জীবনের বা চারপাশের পরিবেশের সাদৃশ্য খুঁজে পায় এবং এভাবেই তার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়। বই পড়লে বাড়ে সহনশীলতা। জন্মায় অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাও। নিয়মিত পড়ার অভ্যাস মানুষকে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শেখায়।

কয়েকটি গবেষণার মতে, বই পড়লে মানুষের স্ট্রেস কমে এবং চিন্তা ও বোধশক্তি বাড়ে।

উরাসি দার্শনিক র‌্যনে দেকার্তের মতে, ‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা।’

ফরাসি লেখক ভলতেয়ার বলেছেন, ‘সে দেশ কখনো নিজেকে সভ্য বলে প্রতীয়মান করতে পারবে না, যতক্ষণ না তার বেশির ভাগ অর্থ চুইংগামের (প্রতীকী অর্থে) পরিবর্তে বই কেনার জন্য ব্যয় হবে।’

ইংরেজ লেখক সিডনি স্মিথের মতে, ‘গৃহের কোনো আসবাবপত্র বইয়ের চেয়ে সুন্দর নয়।’

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’

প্রতিভা বসু বলেছিলেন, ‘বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনো দিন ঝগড়া হয় না, কোনো দিন মনোমালিন্য হয় না।’

একটু চোখ মেললে বই নিয়ে এমন হাজারো মনীষীর উক্তি পাওয়া যাবে। কাজেই বই পড়ার অপরিহার্যতা নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই।

বই মানুষের আচার-আচরণ, রুচির ওপর প্রভাব ফেলে। একজন বইপড়ুয়া মানুষের কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার অন্যদের থেকে একটু হলেও পরিমার্জিত হবে এটাই প্রত্যাশিত। অথচ আমাদের বই কেনা প্রজন্মের মধ্যে তার কমই প্রত্যক্ষ করা যায়। তাদের কথায়, আচরণে বা মানসিকতায় উৎকর্ষতার ছাপ পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি তারা যখন স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয় বা স্ট্যাটাস লেখে, সেখানেও অগণিত অসঙ্গতি বা ভুল দৃষ্টিকটু হয়ে ধরা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বই কেন তাদের অবস্থানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে না? এর কারণ হতে পারে তিন।

এক. যে বই প্রকাশ পাচ্ছে, অতঃপর তরুণরা কিনছে যেগুলো যথেষ্ট মানসম্মত নয়, বইয়ের কন্টেন্টও শক্তিশালী নয়। যার দরুণ তাদের সেভাবে প্রভাবিত করতে পারছে না।

দুই. তরুণরা বই কিনছে কেবল দেখানোর উদ্দেশ্যে। কিছু সেলফি তুলে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করাই মুখ্য হয়ে উঠছে। কিংবা লেখকের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে। কেনার পর বই সেভাবে পড়ছে না। পড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না।

তিন. বই কিনছে, পড়ছে কিন্তু মনোযোগের পুরোটা সেখানে নিবদ্ধ হচ্ছে না। অনলাইনে চটকদার কোনো কন্টেন্ট দেখার মতো ভাসা ভাসা চোখ বুলিয়ে বই পড়ার কাজ সারছে। কিন্তু বই পড়তে চোখের সঙ্গে যে মনও লাগে, তার সংশ্রব ঘটছে না।

পৃথিবীর মানুষকে গর্ব ভরে দেখানোর মতো যে কয়েকটি বিষয় আমাদের আছে, তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম। অমর একুশে বইমেলা বাঙালির প্রাণের স্পন্দন। প্রতি বছর বইপ্রেমীরা অধীর হয়ে থাকেন বইমেলার জন্য। বই বিক্রি শুধু নয়, লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলনমেলায় রূপ নেয় বইমেলা। এ মেলাকে আরো কার্যকর করতে মানসম্মত বই প্রকাশের দিকে যেমন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন প্রকাশকদের, তেমনি বেছে বেছে ভালো বই কেনার দিকেই পাঠকদের মনোযোগ দেওয়া সমীচীন। লেখক-পাঠক-প্রকাশক উভয়ের দায়বদ্ধতা থেকেই বইমেলার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল করা সম্ভব। আমরা যেন বইমেলায় বিচরণ আর সস্তা জনপ্রিয় বই কিনে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো থেকে সরে এসে ভালো বই কিনি, মনোযোগের সবটুকু দিয়ে পড়ি। বই যদি আপনার বন্ধু হয়, তবে সে বন্ধুটি ভালো ও উপকারী যেন হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আপনারই। এত বড় বইমেলা আয়োজনের পরও আমরা যদি একটা বইপড়ুয়া জাতি হয়ে না উঠতে পারি, তার চেয়ে আফসোসের কিছু আর থাকবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close