আলমগীর খোরশেদ

  ১২ জানুয়ারি, ২০২৪

গ্রামীণ ঐতিহ্য

কাঁথা

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশ। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাওয়া হোক না কেন, যাদের জন্ম, শৈশব, কৈশোর, বেড়ে ওঠা গ্রামে, কাঁথা কি জিনিস তাদের বলে দিতে হবে না। উন্নত দেশে গিয়ে দামি বাহারি কম্বলের নিচে শুয়েও মনে পড়ে- গ্রামের মা-চাচিদের বানানো ছেলেবেলার কাঁথা নিয়ে ভাইবোনের টানাটানি, ঝগড়া, খুনসুটি। গ্রামে শীত নিবারণে কাঁথাই ছিল একমাত্র ভরসা। তখন কম্বল ছিল না, থাকলেও তা শহর পর্যন্তই, গ্রামে দেখা যেত না। আর লেপ বানানোর আর্থিক সঙ্গতি সবার থাকত না। অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়িতে লেপ দেখা যেত। প্রচণ্ড শীতে ভারী কাঁথা দুটো বা তিনটে একসঙ্গে গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হতো। বিছানায় ধানের খড় বিছিয়ে তারপর কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমালে উম পাওয়া যেত। কাঁথা গ্রামবাংলার লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত একটি সুচিশিল্প। প্রাচীনকাল থেকে কাঁথার প্রচলন।

পুরাতন জীর্ণ কাপড়, রংবেরঙের সুতো দিয়ে হাতেগড়া গ্রামবাংলার বধূ-কন্যারা মনের মাধুরী দিয়ে তৈরি করতেন কাঁথা বা ক্যাঁথা। পাঁচশত বছর আগে কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত’ বইয়ে কাঁথার কথা উল্লেখ আছে।

কাঁথা হলো পুরোনো শাড়ি, লুঙ্গি বা ছোট ছোট কাপড়ের টুকরো একসঙ্গে বিছিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সেলাই করে বানানো, গায়ে দেওয়ার আচ্ছাদন বস্ত্র। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারে কাঁথা তেলচিটে ময়লা ও রন্দ্রে রন্দ্রে ছিঁড়ে যেত। আঞ্চলিক ভাষায় এই ছিঁড়ে যাওয়া কাঁথাকে বলা হতো ‘ফুল্লেয়া ক্যাঁথা’। গরিব মানুষের শীতের সম্বল কাঁথা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফুল্লেয়া কাঁথা হয়ে যেত। গ্রামে একটা প্রবচন ছিল- ‘গরিব অইয়া তো দেহো নাই, ফুল্লেয়া ক্যাঁথাত কি উম।’ বাড়ির উঠানে বাঁশের আড়ে রোদে শোকাতে দেওয়া শতছিন্ন কাঁথা দারিদ্র্যের ছাপ বোঝা যেত। ধারণা করা হয়, কাঁথা শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘কন্থা’ থেকে। যা পরে ‘কাঁথা’ বা ‘কেঁথা’য় রূপ নিয়েছে। কাঁথা সেলাই করতে যে সুতো ব্যবহার করা হতো, তা ওই কাপড়ের বা শাড়ির পাড় থেকে বিশেষ কায়দায় খুলে নেওয়া সুতো। পা সোজা করে বিছিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে শাড়ির পাড়কে চেপে ধরে বাম হাতে পাড়ের আরেক মাথা থেকে সুতো বের করে সুতোগুলো ডান হাতের বুড়ো আঙুল বাদে অন্য আঙুলগুলোয় প্যাঁচিয়ে গোলাকার সুতোর রিল করা হতো। যা সুঁইয়ে পরিয়ে কাঁথা সেলাই করতেন বউঝি-চাচিরা। পুরোনো কাপড় একটা আরেকটার ওপর স্তূপ করে রেখে সোজা ও চলমান সেলাই চালিয়ে শেষ করতেন নারীরা। নবজাতককে প্যাঁচিয়ে ধরে কোলে নেওয়া, শোয়ানোর কাজে কাঁথা ব্যবহার হতো। তখন নারীরা সন্তানসম্ভবা হলে বাচ্চাদের জন্য ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করতেন। এসব কাঁথা বাচ্চারা বিছানায় প্রশ্রাব করে দিলে তা বারবার পরিবর্তনে ব্যবহার হতো। আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে বলে বাচ্চাদের ‘মুতুনী কাঁথা’। ছোট ছোট কাঁথা সেলাই করতে দেখে সবাই বুঝে যেত- অমুকের বউ পোয়াতি হয়েছে। তখন ননদ-ভাবিরা এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেন। সাধারণত গ্রামে দুপুরে, বিকেলে বউঝিরা বাড়ির কর্তা ব্যক্তিকে খাইয়ে দিয়ে এক ফাঁকে কাঁথা সেলাই করতে বসতেন। বর্ষাকালে যখন একটানা বৃষ্টি হতো, তখন বধূরা অবসর সময় কাজে লাগাতেন কাঁথা সেলাই করে। কাঁথা প্রসঙ্গ নিয়ে অনেক নাটক, সাহিত্যে স্থান পেয়েছে। ছোটবেলায় কাঁথা নিয়ে একটা ডায়ালগ মুখে মুখে শোনা যেত- ‘শোন শোন ময়নার মাগো, কইলে কথা বিশ্বাস করতা নাগো, বেড়া ভাইঙ্গেয়া ক্যাঁথা নিল চোরে’। সময়ের পরিবর্তনে কাঁথার স্থলে নকশিকাঁথার প্রচলন এলো। নকশিকাঁথা ভারী কাঁথার মতো এত কাপড়ের স্তর দিয়ে নয়, দুই বা তিনটা কাপড়ের স্তর মাটিতে চাটাই বিছিয়ে তার চারকোণে চারটি পেরেক মাটির সঙ্গে মেরে টান টান করে দেওয়া হতো। তার ওপর বাহারি রঙের সুতো দিয়ে সুঁইয়ের ফোঁড় নকশি আঁকায় লেগে যেত। নকশিকাঁথায় সুঁইয়ের ফোঁড়ের নকশা ডিজাইন কি হবে, তা গৃহস্থ গৃহিণী আগে মনে মনে ঠিক করে নিতেন। কাঁথার প্রতিটি সুচের ফোঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে কৃষানির মনের, জীবনের, কষ্ট হাসি, বেদনার গল্প। নকশিকাঁথা বিয়ের আসরে বরের আসন, কনের আসন, জায়নামাজ, কোরআন শরীফের গিলাফ, নকশি দস্তরখানা, পান সুপারি রাখার জন্য, পালকিতে বিছানোর জন্য রংবেরঙের সুতোর কারকার্য দিয়ে সেলাই করতেন বউঝি-মায়েরা। গ্রামের নারীদের নিজেদের ব্যবহার, কাউকে উপহার, সর্Ÿোপরি বিক্রি করে একটা উপার্জনের উপায় ছিল কাঁথা সেলাই করা। কলমিলতা, শংখলতা, মটরলতা, গোলাপবাগ নামে নকশিকাঁথার ডিজাইন আছে বলে জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, খৃস্টপূর্ব ৩ হাজার থেকে ১৫০০ অব্দ মানুষ সুচের ব্যবহার জানত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তা ছাড়া নাথ সাহিত্যে গোপীনাথের গানে, পাণিনির ব্যাকরণ, অন্যান্য সংস্কৃত ও পালি গ্রন্থে কাঁথার কথা উল্লেখ আছে।

আধুনিক প্রজন্ম গ্রামের আগের সেই ভারী কাঁথা দেখেনি, ওরা শহরের শপিংমল থেকে নকশিকাঁথা কিনে আনে। লোকশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। যার কৃতিত্ব ছিল একমাত্র গ্রামের নারীদের। কাঁথায় সুচের ফোঁড়নে গ্রামের নিরক্ষর বঙ্গ ললনাদের সেই নান্দনিক শিল্প ফিরে আসুক আবার, আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close