আল মুজাহিদী

  ০১ জুন, ২০১৮

শুভবাদী মানবতাবাদী

পদ্মফুলকে যদি জিজ্ঞাসা করো, ‘তুমি কেন হলে?’-সে বলে, ‘আমি হবার জন্যই হলুম।’ খাঁটি সাহিত্যেরও সেই একটি মাত্র জবাব।

(রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য, সাহিত্যের গল্প)

কবিকেও একটি পদ্ম কোরকের মতো প্রস্ফূটিত হতে হয়।

একজন কবির জীবনে তার কল্পনা শক্তির, সৃজনশক্তির ও স্পৃহার মেলবন্ধ থাকা অতি জরুরি। এই শক্তিই তো একজন কবির জীবনাধার। সব কোমল-কান্তির কল্পনা কবির জন্য কাম্য। কবির কল্পনা তার অস্তিত্বকেই বাঙময় করে। তার মনন মানস প্রান্তরকে প্রত্যক্ষ করে তোলে। কবির অন্বিষ্ট তার কল্পনা সমুচ্চারের একটি ‘প্রতীকৃত’ রূপ। অর্থাৎ তার কল্প-কল্পান্তের বার্তাবরণ। এ কথাটাও সত্য যে, স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নির্বাচিত ও নির্মিত নান্দনিক বিষয়-আশয়, মানবিক অনুসঙ্গগুলো যিনি যতটা যথার্থ করে রূপদান করতে সক্ষম হন তিনিই ততটা মহৎ শিল্পী-প্রকৃত স্রষ্টা। ব্যক্তি জীবনটাই সেখানে মুখ্য। ব্যক্তি মানুষটাই বড়। এই ব্যক্তি বিশিষ্ট এবং সম্পূর্ণ সমাজ সম্পর্কময়। সমাজ জীবন থেকে বৈশ্বিক জীবনও সেখানে এসে যোগ হয় এই ব্যক্তির সঙ্গেই। একজন মহৎ কবি জীবনকেই কেবল জীবনের ভেতর যোজনা করেন। এ যেন তার কল্পনারই এক প্রত্যক্ষীকৃত বিপুল পৃথিবী। কবির কল্পনা ও বিবেকিতা প্রত্যেকের হয়ে ওঠে একসময়। কবির কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা সবার কৌতূহল ও জিজ্ঞাসাকে উসকে দেয় ক্রমশ। আত্মনিমজ্জনের মধ্যদিয়ে কবি যখন সমর্পিত হতে থাকেন সময় সমাজ সকলের অভিপ্রায়ের ভেতরেÑ তখনই তিনি ক্রমশ হয়ে উঠেন জীবন-উদ্দিষ্ট একজন। সব শিল্পীরই একটি বিবেকী ভূমিকা থেকে যায় তার অন্তবর্তী সময়ের জন্য এবং দূরবর্তী কোনো জনসমাজকেও নিজের অন্তর্গত করে নেওয়ার বেলায়। কোনো শিল্পীরই এই দায় কিংবা বিবেকী ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় থাকে না।

তরুণ-প্রাণবন্ত কবি শাহীন রেজা তার শিল্পের যাত্রায় ওই বিবেকী দায়টা বহন করেই চলেন। আপন অস্তিত্বের অমোঘ ঘোষণা দিয়েই তো একজন কবির যাত্রা। কবি তার যাত্রা মুহূর্ত থেকে আপন অস্তিত্বের সেই প্রবল ঘোষণা জ্ঞাপন করে যেতে থাকেন। তিনি সেই স্বাগত স্বসৃষ্ট কণ্ঠস্বর কেবল ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করেন। শাহীন রেজা ধীরে ধীরে আপন কণ্ঠস্বর তৈরি করে যাচ্ছেন। এটাই আশার কথা একজন কবির জন্য। সততই একজন কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, স্বতন্ত্রতা, অনন্যতা সৃষ্টি করে যেতে হয়। ডধষষধপ ংঃবাবহং যথার্থই বলেছেনÑ

ডযবৎব ঃযব াড়রপব ঃযধঃ রং ঁং সধশবং ধ ঃৎঁব ৎবংঢ়ড়হংব

ডযবৎব ঃযব াড়রপব ঃযধঃ রং মৎবধঃ রিঃযরহ ঁং ৎরংবং ঁঢ়.

প্রতিটি ‘ব্যক্তি’ প্রতিটি ‘আমি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সমাজে। কোনো ‘ব্যক্তি’ কোনো ‘আমি’ কিন্তু খুবই আকস্মিক আর আপতিক (পড়হঃরহমবহঃ) নয়। তীব্র ‘আমি’র বোধ কিংবা ‘ব্যক্তিবোধ’, ‘ব্যক্তি চেতনা’ ছাড়া সমাজের স্বাভাবিক বিকাশ ও প্রগতি কখনো সম্ভবপর নয়। ব্যক্তির একা, একপ্রান্তে থাকাটা সীমায়িত নয়। সেটা অসীমের পথেও ধাবিত হতে পারে। একজন কবি তার সীমায়িত জীবন রেখায় শাশ্বত মৃত্যুর ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে একদিন তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বলে সে তার মরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বারবার। জীবনের মহার্ঘ্য প্রদান করে অমরতা পান করতে চায়। জিজ্ঞাসার পরও জিজ্ঞাসা থেকেই যায়।

কবিতাকে, কবির কাজকে ‘ব্যক্তির শখমাত্র’ আজ আর বলা যায় না। কবির অভিপ্রায়কে আজকাল সহমত সহ-অভিপ্রায়ও বলেন কেউ কেউ। সেটাই যথাযথ হোক।

স্বাতন্ত্র্য আর স্বকীয়তারÑউপলব্ধি নিয়েই একজন কবির বাঁচা। কবিকে বেঁচে থাকতে হয়। এখানে একজন কবির বেঁচে থাকার প্রশ্ন। শাহীন রেজা সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন। তার শব্দচারণায় পদচারণায় আমি এমন আভাস পাচ্ছি। তার যাত্রা শুভতর হবে আমি এমনটাই প্রত্যাশা করছি। কেননা কবি হিসেবে শাহীন শুভবাদী, মানবতাবাদীও। শাহীন রেজার জীবনের অভিব্যক্তিÑ বেঁচে থাকার অভিব্যক্তি। তার অভিব্যক্তি ও অভিপ্রায় স্বার্থকতর হতে থাক। ভবিষ্যতের পাঁজি খুলে একদিন দেখতে পারি যদি তখনই প্রীত হব।

শাহীন রেজার একটি কবিতার নাম ‘কেন ভুল পথে যাবো’।

‘একজন শামসুর রাহমানের কাজ যদি হয় মানুষকে স্বপ্ন দেখানো/একজন আল মাহমুদের স্বপ্ন যদি হয়/চোখের মনিতে চিরকালের দুটি জোনাকী আঁকা/একজন ফজল শাহাবুদ্দীনের গন্তব্য যদি/মগ্নতায় অস্থিরতায় চন্দ্রিমায় অমাবস্যায় প্রিয়ভূমি বাংলাদেশ/তবে একজন তরুণ কবি শাহীন রেজা/আমার কি কাজ হবে/আমি কি লাল পিঁঁপড়ের সারির মধ্যে/খুঁজবো আমার গন্তব্য, নাকি হলুদ রোদের মাঝে/ফিঙে চোখ নিয়ে আঁকতে থাকবো আমার ভবিষ্যত/অসহিষ্ণু উড়–ক্কু পাখিদের মধ্যে ঘরে ফেরার আকাক্সক্ষা/জাগ্রত করার চেষ্টা সেতো কবিদের কাজ’

উত্তরসুরীর একান্ত উঠোনে যদি কিছু স্বপ্ন, একটি জোনাকির আলো ঠিকরে পড়ে, কূলায় প্রত্যাশী পাখিদের মতো নস্টালজিকতার ডানা ঝাড়ার শব্দগুলো শ্রুত হয়Ñ তাহলে কবির গন্তব্য উজ্জ্বল রং-রেখায় সমাকীর্ণ হবে।

‘আমি কবি/আমিও কাহ্নপার কাল থেকে ভালোবাসি/পাখি ও কবিতা/যারা আমাদের দেশে বেড়ে ওঠে আমাদের অভ্যাসের মতো/হোক তারা বিভ্রান্ত অগোছালো/আচম্বিতে ঠুকরে খেতে চাক আমার নির্জনতা/কিংবা ভাগ বসাতে চাক আমারই প্রাপ্যে।’

নিখিল চলমান বিশ্ব চরাচর, নিসর্গÑপ্রকৃতি, জীবন ও জগতের বস্তুপুঞ্জই কবির অধীত বিষয়। এই বিশাল মানব সংসার থেকে কোনো কবিই বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে না নিজেকে। নিরন্তর প্রবাহিত জগতের প্রবাহমানতা স্বীকরণ করে কবির যাত্রা। শাহীন সে যাত্রার অভিযাত্রিক।

‘তবু আমি কবি/একজন কবি হয়ে অভ্যাস বৃক্ষ ছেড়ে/কোথাও পারি না যেতে/প্রিয় সেই পাখিদের মতো একান্ত বিশ্বাসে/আমি কেবলই শুনতে চাই ভোরের আজান/ঘুম ভেঙে সেই সব পুরাতন সুর/কাক কিংবা চড়–ই অথবা/আমার প্রপিতামহের অক্লান্ত পুঁথিপাঠ/তার সাথে খুলতে চাই আমার ইচ্ছার গোপন বাক্স/এবং উড়তে চাই নির্ভয়ে শিকলমুক্ত কুয়াশার সাথে।’

কবি পাখির উড্ডীয়মানতার সঙ্গে দিগন্তে মেলাতে চান আপন আত্মার বিহঙ্গটিকে।

‘আমি কবি/বেঁচে আছি পাখি ও কবিতার কাছাকাছি।’

কবিকে ভ্রম, বিভ্রম যেনো কখনো না পেয়ে বসে। পথের ক্লান্তিও কবির। বিরামহীন, বিশ্রামহীন, বিরতিহীন তার অভিযাত্রা। কবিতার রূপ-রস ও রহস্যনিচয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনার অবধি নেই কোনো। কবিতার কৃৎ কৌশল, শৈলী, আঙ্গিক, নিরিখ বিবেচনায় আনা খুবই কঠিন কাজ। সে কাজে পা না বাড়িয়ে এখানে থেমে যাওয়াই বিধেয় মনে করি। কবিতার পথ বড়ই আঁকা আঁকা। বহুÑ বঙ্কিম। সব কবিকেই অন্য কবির ধারা থেকে ভিন্নমুখিন হতে হয়। অনবদ্যতা ও অনন্যতায় কবিকে জেগে থাকতে হয়। বেঁচে থাকতে হয়। কবি শাহীন রেজা সেই অনন্যতায় কাব্যভুবনের অন্তবর্তী হবেন এই আমার প্রত্যাশা। কবিকে তার কালি ও কলমে সমাজের বিরোধাভাস মিটিয়ে দিতে অনেক দূর যেতে হবে। শাহীন রেজা সেই সুদূরেরই এক অভিযাত্রী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist