আহমেদ আমিনুল ইসলাম

  ২৬ মার্চ, ২০২৪

জন্মভূমির গান স্বাধীনতার গান

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে শুরু হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম। তার এ আহ্বানের সুর বাঙালিচিত্তকে মথিত করেছে। তাই মাতৃভূমি রক্ষার জন্য সশস্ত্রযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের আপামর মেহনতি মানুষ। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বান ছিল বাঙালির শাশ্বত সংগীতের মতোই অনিবার্য। স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল দেশমাতৃকা রক্ষার সংগ্রাম, মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রাম, অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। আগ্রাসী ও আক্রমণকারীর কবল থেকে নিজ নিজ অঞ্চল, জন্মভূমি তথা মাতৃভূমি রক্ষার সংগ্রাম, দূরাগত শক্তির অধীনস্থতা থেকে মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম বহু প্রাচীন এক মানবিক সংবদ্ধতার দৃষ্টান্ত। জন্মস্থান, জন্মভূমি, মাতৃভূমি, দেশ বা রাষ্ট্র প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে রাজনৈতিক নানা প্রপঞ্চ যুক্ত থাকলেও এর সঙ্গে মানুষের মানবীয় আবেগের সম্পর্কও অনেক গভীর। সুপ্রাচীনকাল থেকে জন্মস্থান বা জন্মভূমিকে মাতৃতুল্যরূপেই কল্পনা করা হতো। তাই প্রাচীনকালের শিল্পসাহিত্যে দেখা যায় এ অঞ্চলে বহুল প্রচলিত কাব্যের ভেতর স্থান করে নিয়েছে- ‘জননী, জন্মভূমি- স্বর্গাদপি গরিয়সী’ আপ্তবাক্য। এককথায়, জন্মভূমি ও জননীকে সমান্তরালভাবে প্রতিস্থাপন করে চিন্তার প্রকাশ বোধ করি সভ্যতার শুরু থেকেই। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালি কবিরাও জন্মভূমির প্রতি এরূপই মহান চিন্তার অনুগামী ছিলেন। তারা তাদের কাব্যকীর্তির ভেতর দিয়ে সেই আবেগের প্রকাশই মূর্ত করেছেন। জননীর বন্দনা যেমন কাব্যসাহিত্যে করেছেন, তেমনই বন্দনা করেছেন মাতৃভূমির, বন্দনা করেছেন মাতৃভাষারও।

শুধু প্রচীন বা মধ্যযুগেই নয়, আধুনিককালেও এর ব্যত্যয় দেখা যায় না। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে কবি-সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যচর্চায় মাতৃভূমি, মাতৃভাষা এবং মাকে আরাধ্য ভেবেছেন। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম মাতৃভাষা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তার গভীর আবেগ ও দেশপ্রেমের অনুরাগ। তার বিখ্যাত চরণ- ‘যে জন বঙ্গেত জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী/সেজন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ আবার আধুনিক যুগের সূচনায় ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কী অপূর্ব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে?/যে ডরে ভীরু সে, শত ধিক তারে।’ আবার রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান ও কবিতায় জন্মভূমির প্রতি আকণ্ঠ নিবেদন দেখতে পাই।

স্বদেশি আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ বিপর্যয়েরকাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে শাশ্বত পথের নির্দেশনা দিয়েছেন তার কবিতা ও গানের মধ্য দিয়ে। তার দর্শনচিন্তার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে যেকোনো বিপর্যয়েরকালে সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রনাথের বহুসংখ্যক গানে সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রেরণা লাভ করেছেন, সশস্ত্রযুদ্ধে নিজেদের নিবেদন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। রবীন্দ্রাথের এরকম অনেক গানের একটি- ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা/তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচলপাতা।’ এ গানের মধ্যেও তিনি জন্মভূমি তথা দেশকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন। গানে আছে- ‘ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে।’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানও দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করে গীত হয়েছে- ‘মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো।’ আবার ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ কায়মনে প্রার্থনা করেছেন বাঙালির জন্য। যেমনটি এগানে ব্যক্ত- ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল/পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান/বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন/এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান।’ রবীন্দ্রনাথের এরকম অনেক গান আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছে।

রবীন্দ্রনথের সমকালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও দেশমাতৃকার প্রতি গভীরতম মমতায় রচনা করেন- ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি, সে আমার জন্মভূমি, সে আমার জন্মভূমি।’ এ গানের ভেতর আছে মমতাময় মানবিক সম্পর্কের গভীর আবেগের কথা- ‘ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ/ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’

রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও অসংখ্য গান এবং কবিতা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছে, প্রেরণা জুগিয়েছে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গ করতে তরুণচিত্তকে করেছে দ্বিধাহীন। নজরুল ইসলামও দেশমাতৃকার বিচিত্র রূপ কল্পনায় রচনা করেছেন অনেক গান। তারই একটি এরূপ- ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পলি জননী/ফুলে ও ফসলে কাদামাটি জলে ঝলমল করে অবণী/’ কিংবা- ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’ এরকম আরো কত গান! আর ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’ গানটিও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাজানো হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা সঞ্চার করতে। পূর্বসূরি কবি ও গীতিকারদের পথ অনুসরণ করে যুদ্ধ চলাকালে অনেক কবি ও গীতিকার মুক্তিযুদ্ধ, মাতৃভূমি ও দেশপ্রেমের নানা মাত্রিক রূপ কল্পনার আশ্রয়ে অজস্রগান রচনা করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের প্রত্যক্ষ আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ এবং যুদ্ধের পক্ষে মনোবল দৃঢ়তর করার অভিপ্রায়ে রচিত হয়েছে সংগীত। এসব সংগীতও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি মনোনিবেশ এবং প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করেছে। এরকম বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি গান- ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি/মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ এ গানে একইসঙ্গে যুদ্ধ আবার তার বিপরীতে চমৎকারভাবে বিশ্বশান্তির কথাও ব্যক্ত হয়েছে। গীত রচয়িতার অসামান্য নৈপুণ্য প্রকাশ পায় যখন তার এ গানেই ব্যক্ত হয়ে ওঠে- ‘মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি।’ এ সময় রচিত হয়েছে- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’/হবে হবে হবে নিশ্চয়/কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে/নতুন সূর্য উঠার এই তো সময়।’ এ গানের মধ্যে ঘোষণা করা এরূপ উদ্দীপনা- ‘আর নয়/তিলে তিলে বাঙালির এই পরাজয়।’ আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস সঞ্চারের জন্য রচিত হয়েছে- ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/ রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল/জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে রক্ত লাল, রক্ত লাল রক্ত লাল/শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে/অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে/রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে/নয়া বাংলার নয়া সকাল। মা গো ভাবনা কেন/আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/তোমার ভয় নেই মা/আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ এ গানেই বলা হয়েছে- ‘আমরা হারবো না হারবো না/তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না।’ কী দৃঢ় প্রত্যয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের! এসব সংগীতে উদ্বেলিত না হয়ে পারা যায় না! এসব গানকেই স্বাধীনতা সংগ্রামরত মুক্তি সেনারা জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

আবার যুদ্ধ শেষে যুদ্ধের ঘটনার বিবরণ ও দেশের জন্য আত্মোৎস্বর্গকারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নিবেদনমূলক গানও রচিত হয়েছে। যে গান শুনলে যেকোনো মানুষই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক পটভূমি সম্পর্কে জানতে পারবে। এ গান যেন ৩০ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত- ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে/বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা/তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না।/না না না শোধ হবে না।’

আবার নিয়তির অমোঘ এক আশঙ্কাজাত ভবিষ্যদ্বাণীর উচ্চারণও শুনি এ গানেই- ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/বড় বড় লোকেদের ভিড়ে/জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবে না।’ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে রচিত- ‘যে মাটির বুকে/ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা।’ এ গানেই আছে- ‘সে মাটি ছেড়ে অন্য কোথাও/যেতে বলিস না/দে না তোরা দে না/সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না।’

স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, সর্বোপরি স্বাধীন দেশ সম্পর্কে মানুষের বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষার আশ্রয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গান। এসব গানে আমাদের স্বাধীনতার আস্বাদ যেমন প্রিয়তর হয়ে ওঠে, তেমনি এসব গানের অভ্যন্তরীণ সুর-মাধুর্য মাতৃভূমির প্রতি আমাদের সব ধরনের নিবেদনকেও পবিত্রতর করে তোলে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close