অংকন বিশ্বাস

  ২৬ মার্চ, ২০২৪

ক্র্যাকডাউনের রাতে জগন্নাথ হল

মুক্তিযুদ্ধে ও বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকার করতে হয়েছে অনেক বলিদান ও আত্মত্যাগ। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়টি আবাসিক হল সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার মধ্যে জগন্নাথ হল অন্যতম।

জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন তিনটি হলের একটি। এ হলটি প্রতিষ্ঠার জন্য জমিদান করেছিলেন বালিয়াটি পরগনার জমিদার শ্রী কিশোরীলাল রায় চৌধুরী। তার বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে এ হলের নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এ হলটি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এ হলের আবাসিক ছাত্ররা। বিভিন্ন দমন-নিপীড়ন চালানোর পরও তারা পিছপা হননি। এজন্য ২৫ মার্চ কালরাতে সর্বপ্রথম আঘাত আসে এ হলের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়টি আবাসিক হলে তারা গণহত্যা চালায়, তার মধ্যে জগন্নাথ হলের গণহত্যা ছিল সবচেয়ে নৃশংস। ২৫ মার্চের আগেই হলের বেশিরভাগ ছাত্র বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। বাকিরা টিউশন বা অন্য কারণে থেকে গিয়েছিলেন। অনেকে ঠিক করেছিলেন, তারা পরদিন যাবেন। কিন্তু সেদিন আর তাদের জীবনে আসেনি। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে হল থেকে জীবিত ব্যক্তিদের তথ্যমতে, সেদিন রাত ১০টার দিকে হলের ডাইনিং বন্ধ হয়ে যায়। রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী হলের পূর্ব দিকের দেয়াল ভেঙে মিলিটারি ট্যাঙ্ক নিয়ে হলে প্রবেশ করে। এরপর মর্টার নিক্ষেপ করা হয় উত্তর বাড়িতে (নর্থ বিল্ডিং)। একইসঙ্গে চলে মেশিনগান। ছাত্রদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর হলের গেট ভেঙে চালান হয় নির্মম গণহত্যা। উত্তর ও দক্ষিণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ছাদের কার্নিশ, টয়লেট বা পানির ট্যাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে থাকা ছাত্ররাও রেহায় পাননি। সবাইকে হত্যা করে সবাইকে বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়। রেহায় পাননি হলের প্রাধাক্ষ জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা থেকে শুরু করে হাউস টিউটর পর্যন্ত। প্রাচ্যের সক্রেটিসখ্যাত বিখ্যাত দার্শনিক এবং জগন্নাথ হলের সাবেক প্রাধাক্ষ গোবিন্দচন্দ্র দেবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ আত্মভোলা ও চিরকুমার মানুষটার মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারিয়েছিল।

সেই রাত্রে দৈবিকভাবে বেঁচে যান জগন্নাথ হলের কিছু ছাত্র ও কর্মচারীর পরিবারের লোকজন। হলের তৎকালীন নিরাপত্তাকর্মী সুনীল চন্দ্র দাস সেই রাতে শহীদ হলেও বেঁচে যান তার স্ত্রী পুত্র। তার স্ত্রী বকুল রানী দাস এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। তার ভাষ্যমতে, রাতে মিলিটারি হলে আক্রমণ করলে তার স্বামী সুনীল চন্দ্র দাস দ্রুত রুমে এসে তাদের নিয়ে অ্যাসেম্বলির পাশের একটি রুমে সরস্বতী প্রতিমার পেছনে লুকিয়ে থাকে। সঙ্গে আরো কয়েকজন প্রতিবেশী ছিলেন। এ সময় একজন মিলিটারি অ্যাসেম্বলি তল্লাশি করতে আসে এবং তখন একটি বাচ্চা হঠাৎ কেঁদে উঠলে মিলিটারি ঠিক পেয়ে যায় এবং জোরপূর্বক তাকে ধরে নিয়ে যায়।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাম্প খালাসী সুশীল রঞ্জন দের ভাই কানাই রঞ্জন দে বলেন, ‘আমি আমার ভাইয়ের মৃতদেহটা খুঁজে পায়নি। সেদিন জগন্নাথ হলে এসে দেখি শুধু লাশ আর লাশ, হাত-পা বাঁধা লাশ। চোখ দিয়ে অনেকের জল গড়িয়ে পড়ছে। কী বীভৎস দৃশ্য! এত লাশের মধ্যে আমার ভাইকে পায়নি। সন্তানহারা আমার মা সারা জীবন কেঁদেছে।’

স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নুরুল উল্লার তোলা একটি গোপনে ভিডিও ক্লিপে তৎকালীন জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের একটি আংশিক চিত্র উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, পাকিস্তানি মিলিটারিরা কয়েকজন ছাত্রকে লাশ জড়ো করার নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশনা পালন করার পর তাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়। সবাইকে মারার পর বুলডোজার দিয়ে তাদের মরদেহ হলের মাঠে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এভাবে দেশের সূর্যসন্তানদের শেষ করে দেওয়া হয়। সেদিন জগন্নাথ হলে ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যসহ বহু প্রতিভাবান শিক্ষক নিহত হন। হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ গোবিন্দ চন্দ্র দেব থাকতেন হলের নিকটে একটি বাড়িতে। সেখানে গিয়ে তাকে এবং তার পালিতা কন্যার স্বামীকে হত্যা করে মিলিটারিরা। পরে তার নিথর দেহ জগন্নাথ হলের মাঠে পুঁতে দেওয়া হয়। হলের তৎকালীন প্রাধ্যাক্ষ জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান ও তার আত্মীয়কে একসঙ্গে গুলি করা হয়। মুনীরুজ্জামান তখনই মারা গেলেও জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা বেঁচে ছিলেন। কারফিউ চলার জন্য ওনাকে দুদিন পর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার দুদিন পর উনি মারা যান। হলের পাশে ৪ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে (মধুদা) ও তার পরিবার। সেই রাতে তাকে, তার গর্ভবতী স্ত্রী, বড় ছেলে ও ছেলের বউকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরে তাদের জগন্নাথ হলের মাঠে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। রতনলাল চক্রবর্তীর মতে, ওই রাতে জগন্নাথ হলে ৬৬ ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারী শহীদ হন। সবার পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শহীদদের স্মরণে জগন্নাথ হলের উত্তরের বাড়িকে শহীদ গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবন, দক্ষিণের বাড়িকে জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ভবন নামকরণ করা হয় এবং সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। কয়েক বছর আগে তাদের স্মরণে হলে একটি স্মৃতিফলক ও শহীদ শিক্ষকদের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। এদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের আত্মত্যাগ আমরা কখনো ভুলব না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close