মো. মনির হোসেন, বেনাপোল (যশোর)

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯

এক হাসপাতালেই এত সমস্যা?

শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ পদের মধ্যে ১৬টিই শূন্য। ডাক্তারের বিরুদ্ধে অনুপস্থিতি, রোগীর প্রতি অবহেলা ও কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ

প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের শার্শা উপজেলার একমাত্র চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চলছে নামমাত্র চিকিৎসক দিয়ে। তার ওপর এদের বিরুদ্ধে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ও বেসরকারি ক্লিনিকের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া রোগীদের ওষুধ না দেওয়া, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের কাছে ভিজিট নেওয়া, সরকারি ওষুধ চোরাই পথে বিক্রিসহ অভিযোগ আছে এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সার্জারি যন্ত্রপাতি অপ্রতুল, অপরিচ্ছন্নতা, ওয়ার্ডে পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুমসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ হাসপাতাল। ফলে ক্রমেই মুখথুবড়ে পড়ছে হাসপাতালটি।

রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালে ভর্তির পর পরই রোগীর অবস্থা ভালো নয়Ñবলে যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন ডাক্তাররা।

হাসপাতালের তথ্য সূত্রে জানা যায়, শার্শার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা ৫০ শষ্যাবিশিষ্ট উপজেলা (নাভারণ-বুরুজবাগান) স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। ১৯৬২ সালে নির্মিত এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি জেলার শার্শা ও ঝিকরগাছা উপজেলার ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা নির্ভরতার প্রতীক। ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু গত তিন বছরেও এখানে কোনো জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে ২২ জন চিকিৎসক পদে থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ছয়জন। এদিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্জিক্যাল বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ, গাইনি বিভাগ ও অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগে কনসালট্যান্ট পদে কখনো কোনো ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়নি একযুগ ধরে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, হাসপাতালসংলগ্ন দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল। এখানে কয়েক হাজার শ্রমিক পণ্য উঠানামার কাজ করেন। প্রায় সময়ে শ্রমিকরা আহত হন। ডাক্তারের অভাবে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে যেতে হয় বেনাপোল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে। যেতে যেতে পথে রোগী মারা গেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে।

সরেজমিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টা থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ১০টার আগে কোনো চিকিৎসককে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা মেলে না। আবার দুপুর ১টা বাজলে কোনো ডাক্তারকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খুঁজে পাওয়া যায় না। গত দুই দিনে সিজার করা রোগীর ড্রেসিং হয়নি এমন রোগীও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডাক্তার না পেয়ে চলে যাচ্ছেন।

বহির্বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতি ৫০ হাজার মানুষের জন্য একজন মাত্র ডাক্তার। প্রতিদিন এখানে প্রায় ২০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। এছাড়া গড়ে পাঁচ থেকে আট জন রোগী ভর্তি থাকেন।

উপজেলার আমতলা-গাতিপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা রওশনারা (৬০) ও তাহেরা বেগম (৫৫) জানালেন, সকাল ৮টায় টিকিট কেটে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি। ১০টা বাজতে চললো এখনও কোনো ডাক্তার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেননি। নাভারনের ফরিদুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা নিজেই বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের নয়নতারা (২৭) জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ থেকে সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নিজামুল ইসলাম কয়েকটি রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে বলেন। আমরা গরিব মানুষ, বেসরকারি হাসপাতালে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে অনেক টাকা লাগে তাই নাভারনের এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছি। কিন্তু ডাক্তারের অভাবে আমরা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছি না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক কর্মচারী জানালেন, প্যাথোলজিক্যাল বিভাগের টেকনিশিয়ান হুমায়ন কবির পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিজস্ব প্যাথোলজিক্যাল বিভাগে যেসব রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় তার ৮০ ভাগ রোগী কমিশন বাণিজ্যের জন্য চিকিৎসকরা বাইরের পছন্দের বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠাচ্ছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে টেকনিশিয়ান হুমায়ুন কবীর উল্লিখিত পরীক্ষাগুলো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিজস্ব প্যাথোলজিক্যাল বিভাগ থেকে করানো হয় বলে দাবি করেন।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) এনাম উদ্দিন শিপন অফিসের বিভিন্ন কাজে অধিকাংশ সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতালের বাইরে থাকেন। দাঁতের চিকিৎসক রাবেয়া খাতুনের চিকিৎসাসেবার মান সন্তোষজনক নয় বলে জানান উপস্থিত রোগীরা। তিনি সারাক্ষণ মোবাইল ফোনে ফেসবুক দেখেই সময় কাটান। তার সহকারী আনিছুর রহমান রোগীদের সেবা না দিয়ে প্রায়ই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় বা অন্যরুমে গল্প করে সময় কাটাতে দেখা যায়। নাভারন বাজারে আনিছুর রহমানের নিজস্ব দন্ত চিকিৎসালয় থাকায় তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক উৎপলা দত্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে না বসে অধিকাংশ সময়ে বাসায় অবস্থান করেন। হোমিও চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর উপস্থিতি দেখে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা মোবাইল ফোনে চিকিৎসক উৎপলা দত্তকে চেম্বারে ডেকে নিয়ে আসেন। ডাক্তাররা না থাকলে মাঝে মধ্যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক উৎপলা দত্ত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিপর্যস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা আনিত অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২টি ডাক্তারের পদ থাকলেও এখানে মাত্র ছয়জন ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া আছে। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি আজ থেকে কোনো রোগী আর বাহিরে পরীক্ষার জন্য না পাঠাতে। সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের সংকট রয়েছে, কোথাও দুই থেকে তিনজনের বেশি ডাক্তার নেই। সরকারিভাবে নতুন করে নিয়োগ দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close