রাজীবুল হাসান ও শফিউল্লাহ্ আনসারী, ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে

  ১০ জানুয়ারি, ২০১৮

শিল্প-কারখানার বর্জ্যে খিরু নদীর মরণদশা

নদীর পানি খিরের (গুড়ের পায়েস) মত সুস্বাধু ছিল বলে নামকরণ হয়েছিল খিরু নদী, এমনটাই কথিত আছে গাজীপুরের উত্তর সীমান্ত ও ভালুকা উপজেলাবাসীর কাছে। এর ওপর নির্ভর করতো এই অঞ্চলের দিনমানের কাজ, কৃষি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা একেবারেই উল্টো, এলাকাবাসীর ভয়ের কারণ। কুচকুচে কালো দুর্গন্ধযুক্ত পানি শরীরে লাগলে ঘা হয়। জমিতে দিলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। দুর্গন্ধে আশপাশের মানুষ অতিষ্ঠ। মাছশূন্য নদী। পানিতে ব্যাঙ লাফ দিয়ে পড়লেও মরে ভেসে ওঠে। এক সময়ের প্রসস্ত নদীর অবস্থা এখন নর্দার শীর্ণ নালায় পরিণত হয়েছে। এই অবস্থা শুধু খিরু নদী নয়, ভালুকার মরাপুরাসহ কয়েকটি খাল ও বিলের মোটামুটি একই দশা।

নদীর পাড়ে শতাধিক কারখানা থাকলেও মাত্র ৩১টি কারখানায় রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধনের ইটিপি আছে। বাকী কারখানাগুলো অপরিশোধিত বর্জ্যই নদীতে ফেলে। তাছাড়া বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নাই কারখানাগুলোতে। অভিযোগ আছে, ইটিপি আছে এমন কারখানাগুলোও অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলার কৌশল হিসেবে আরেকটি গোপন পাইপ ব্যবহার করে। প্রশাসনের চোখ এড়াতে বিকেল পাঁচটার পরে এই খুলে দেওয়া হয়। এই সময় কারখানা এলাকার কাছাকাছি রাস্তা ও বসবাসকারী গ্রামে অবস্থান করা কঠিন হয়ে যায়।

বাটাজোর-সীডস্টোর রাস্তার পথচারী আলমগীর হোসেন বলেন, বিকেল হলেই দুর্ঘন্ধের মাত্রাটা ভারে। রাস্তা দিয়ে চলা চল করা যায় না। কয় বছর আগেও খিরু নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ ধরা যেত। কিন্তু এখন মাছ তো ধুরের কথা পানির দিকে তাকানোও যায় না।

খিরু নদীর পাশে বাস করা খাইরানী এলাকার বাসিন্দা জিয়াউর রহমান বলেন, পাঁচটা বাজলে আর বাড়িতে থাকা যায় না। পাইপ ও ড্রেন দিয়ে আসা বিভিন্ন রঙের তরল বর্জ্যের বেশির ভাগ অপরিশোধিত। পাইপলাইন, ড্রেন ছাড়াও নালা, কৃষিজমি ও জলাশয় গড়িয়ে কারখানার তরল বর্জ্য পড়ছে খালে। আলকাতরা রঙের এসব পানি বিলাইজুড়ি দিয়ে খিরু নদীতে পড়ছে প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি খিরু নদী ঘুরে দেখা যায়, নদী, শাখা নদী ও খালের দুই তীরে গড়ে উঠেছে সহ¯্রাধিক কারখানা। কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত নানা রঙের তরল বর্জ্য পাইপ ও ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি কৃষিজমি ও নদীতে এসে পড়ছে। কোথাও নদীর বুক ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা। আবার কোথাও নগরী ও হাট-বাজারের কঠিন বর্জ্য ও পয়ঃপ্রণালীর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে পানি বিবর্ণ হয়ে বিষাক্ত ও আলকাতরার মতো কালো গেছে। তীব্র ঝাঁঝাঁলো দুর্গন্ধে ওই পানির কাছে যাওয়া যায় না। এলাকাবাসীর প্রায়ই চর্ম এলার্জিসহ ভয়ানক চর্মরোগ লেগেই থাকে।

স্থানীয় ও প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, এক সময় শীতলক্ষ্যা হয়ে তুরাগ দিয়ে রাজধানীর সঙ্গে নদীপথে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে খিরু নদীর তীরে ভালুকায় গড়ে ওঠে একাধিক ব্যবসায় কেন্দ্র, নৌ-বন্দর শিল্পকারখানা। ৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর খিরু নদীর প্রকৃতি সর্পিলাকার। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলা থেকে শুরু হয়ে ভালুকা উপজেলার সুতিয়া নদীতে মিশেছে। সুতিয়া শ্রীপুরের কাওরাইদ ও গফরগাঁওয়ের ত্রিমোহনীতে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মিশেছে। ব্যক্তি ও কারখানা মালিকদের আগ্রাসনে দখল হয়ে যাওয়া অনেক খালই খিরু নদীর মত ক্রমইে সংকুচতি হয়ে আসছে।

দখলদারে অভিযুক্ত একাধিক কারখানার যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অস্বীকার করে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন। এছাড়া কয়েকটি কারখানায় সাংবাদিক পরিচয়ে ঢুকতেই বাধা দেয়।

এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, খিরু রক্ষায় ‘খিরু নদী বাঁচাও’ ও ‘লাউতি নদী বাঁচাও’ আন্দোলন করেও লাভ হয়নি বলে। তাদের দাবি ছিল, শিল্পকারখানা থেকে যেন অপরিশোধিত বর্জ্য আর নদী-খাল-বিলে ফেলা না হয় এবং পরিপূর্ণ পরিশোধিত বর্জ্য জোয়ারভাটা আছে এমন কোনো নদীতে ফেলা হয়, তা নিশ্চিত করা। যদিও ইতোমধ্যে ময়মনসংিহ জেলা প্রশাসক খললিুর রহমান লাউতি নদী পরিদর্শন করে কিছু অংশ খননরের উদ্যোগও নিয়েছেন বলে জানান।

কারখানা সমৃদ্ধ ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহাম্মেদ বাচ্চু বলেন, বেদখল নদী ও খাল উদ্ধার করতে ডিসি বরাবর আবেদন করা হয়েছে। খিরু নদী দখল দূর্ষণের সাথে জড়িত রিদিশা, স্কয়ার, অরচার্ড, এসএমসি, ভাবি সোয়েটার, হাওয়াইল টেক্স., নোমান, ইকো সুজসহ বেশ কয়েকটি কারখানার বিরুদ্ধে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের সভাপতি মো. মনির হোসেন বলেন, শিল্পের আগ্রাসনে মরতে বসেছে খিরু নদী। কিছু শিল্প মালিকদের অনৈতিক ব্যবসায়ীক মুনাফা লাভের কারণেই নদীটির এ হাল। অল্প দিনের মধ্যেই এ খিরু নদী রক্ষায় নদী পাড়ে বসবাসরত লোকজনদের নিয়ে সচেতনতামূলক সমাবেশ করা হবে বলে তিনি জানান।

ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নূর আলম বলেন, ভালুকায় সব মিলিয়ে ৩১টি কারখানায় ইটিপি রয়েছে। ময়মনসিংহ পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রয়োজনীয় লোকভলের অভাবে কাজ করতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবুও গত মাসেও ভালুকা অঞ্চলে পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, শেফার্ড নামে একটি কারখানাকে জরিমানও করা হয়েছিল। খিরু নদীর আশপাশে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আরো বেশি দৃষ্টি রাখা হবে বলেও তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন।

ভালুকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুদ কামাল এ ব্যপারে বলেন, দখল হওয়া খালগুলো চিহ্নিত করে উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist