মনিরুল ইসলাম

  ২০ মার্চ, ২০২১

মায়ের মনোবলে আতিকের বাঁকবদল

‘জীবনে যতই যশ-খ্যাতি-সুনাম অর্জন করি না কেন; অতীত কখনো ভুলব না। বাস্তবতা খুব কাছ থেকে দেখেছি। জীবনের দুর্গম পথ অতিক্রম করেই এতদূর এসেছি। ছোটবেলার বিভীষিকাময় দিনগুলো এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে’ প্রতিদিনের সংবাদকে কথাগুলো বলছিলেন সদ্য বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পাওয়া ডিফেন্ডার মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান।

শেরপুরের ছেলে আতিক তখন অবুঝ বালক। এ বয়সেই জন্মদাতা বাবাকে হারান। স্বাভাবিকভাবেই বাবার শাসন-স্নেহের ভাগীদার হতে পারেননি। পাননি জমিজমা-পৈতৃক সম্পত্তিও। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে হওয়ায় এমন বৈষম্যের শিকার ছিলেন। আগের সৎভাইয়রা সব সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে নিজেদের ভা-ার পূর্ণ করে ফেলেছেন। তাই আতিকের জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। আনন্দহীন-বেদনাময় সেই মুহূর্তগুলো কেবল হাতছানি দিয়ে গেছে। সে সময় মুখে দুমুঠো অন্ন তোলা ছিল কঠিন। ভারাক্রান্ত মনে তিনি বললেন, ‘দিশাহারা হয়ে সে সময় মা হোটেলে রান্নাবান্নার কাজ নেন। আমাদের তিনবেলা আহার জোগাতে মায়ের সে কী সংগ্রাম! দিন-রাত খাটাখাটুনির অন্ত ছিল না। ঘুমহীন কত রাত কাটিয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে স্মৃতিগুলো মনে পড়লে দুচোখ অচিরেই অশ্রুসজল হয়ে যায়। এখনো বড় মাপের ফুটবলার হতে পারিনি ঠিক। কিন্তু মাকে আর হোটেলে কাজ করতে হয় না। এ নিয়ে আমি গর্ববোধ করি।’অথচ আতিকুজ্জামানের বাবা বদিউজ্জামান ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। অর্থ-সম্বল ভালোই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সংসারের ছেলে বলে উপেক্ষিত ছিলেন বরাবরই। যে কারণে তাকে ও ছোট ভাই মেহেদীকে নিয়ে মা হামিদা বেগম কষ্টেসৃষ্টে জীবন অতিবাহিত করেছেন। মায়ের হার না মানা প্রবল মানসিকতায় লেখা হয়েছে বাঁকবদলের গল্প। জীবনের পরতে পরতে ঘাত-অভিঘাতের পরও দমিয়ে যাননি আতিক। তার সামনের দিনগুলো ছিল বড্ড বেশি রোমাঞ্চকর। যেখানে পেটের ভাত জোগাড় করা ছিল কঠিন, সেখানে ফুটবল স্রেফ বিলাসিতা!

এমন কষ্টের মধ্যেই আতিকের ফুটবলে হাতেখড়ি। অথচ এই ফুটবল ছিল আতিকের একদম অপছন্দের খেলা। তার মন পড়ে থাকত ক্রিকেটে। নিয়তির ভুলেই হয়তো আজ ফুটবলার হয়েছেন! প্রতিদিনের সংবাদকে সেই রোমাঞ্চকর গল্প শোনালেন আতিক, ‘এক দিন স্কুল থেকে এসে ব্যাকপ্যাক বাসায় রেখে সোজা নিজ জেলা শেরপুর স্টেডিয়ামে চলে যাই। তখন সেখানে প্রথম বিভাগের খেলা চলছে। গিয়ে দেখি আমার বয়সি অনেক ছেলে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কীসের যেন যাচাই-বাছাই চলছে। কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে দেখি, জেলা অনূর্ধ্ব-১৩ দলের জন্য খেলোয়াড় নিচ্ছে। তখন আমি এক বড় ভাইকে বললাম, আমি চান্স পাব কি না। তিনি তখন আমার মুখের ওপর না করে দিয়েছেন। তার নামটা বলতে চাচ্ছি না। সেখানে জেলা ফুটবল অ্যাসেসিয়েশনের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক মানিক স্যার ছিলেন। তার মাধ্যমে ট্রায়াল দিলাম। শেষমেশ সব নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে মূল দলে ঠাঁই পাই। সেদিন মানিক স্যার না থাকলে আমি ফুটবলার আতিকুজ্জামান হতে পারতাম না। কোথায় যে পড়ে থাকতাম!’ এরপর স্থানীয় কোচ সাধনের নজরে আসেন আতিক। তার হাত ধরেই সামনের ধাপগুলো পার হন। সে সময় ঘরে ঠিকমতো খাবার থাকত না। তাই কোচই নাশতার ব্যবস্থা করে দিতেন। ভুট্টো নামের তার এক বড় ভাই এই নাশতা ফ্রি করে দেন। যাতে করে সুস্থ থেকে ট্রায়াল দিতে পারেন আতিক।

২০১৩ সালটা ছিল আতিকের জন্য সোনায় সোহাগা। অ্যাকাডেমির কোচ সাহাব উদ্দিনের মাধ্যমে সে বছর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ট্রায়াল দেন উত্তীর্ণ হন সফলতার সঙ্গে। এরপর অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টে মোহামেডানের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ওই বছরেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ দলে জায়গা পেয়ে ফের বাজিমাত করেন। ২০১৪ সালে আবাহনীর হয়ে খেলেন। ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৬ সাফ শিরোপা জয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। এরপর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলেছেন ভিক্টোরিয়ার হয়ে। পরে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে নাম লেখান। দাপিয়ে খেলেছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল ও অনূর্ধ্ব-২৩ দলের হয়েও। এত পরিশ্রম আর সাধনার পুরস্কার পেলেন অবশেষে। প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাক পেয়ে।

তবে দেশের জার্সি গায়ে চড়ালেও পা মাটিতেই রাখছেন আতিক। প্রতিদিনের সংবাদকে বললেন, ‘সবার আগে একজন ভদ্র খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করব। এরপর দেশসেরা ডিফেন্ডার হতে চাই। যেন সবাই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। খ্যাতির মোহে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে চাই না। সামনে দুর্বার গতিতে এগোনোর লক্ষ্য আমার।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close