আবদুস সালাম

  ১৮ আগস্ট, ২০১৮

কাকেদের বোধোদয়

অনেক দিন আগের কথা। শ্রীখ- নামে একটি শহর ছিল। শহরে লোকসংখ্যা ছিল অনেক বেশি। সেই শহরে দালানকোঠা ও গাছপালার কোনো অভাব ছিল না। শহরটিতে অনেক ধরনের পাখি বাস করত। কাকেরা দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয় লক্ষ করেছিল। আর তা হলোÑসারা বছর কোকিলদের দেখা না গেলেও বসন্তকাল এলে ওরা ঠিকই দেখা দেয়। কোকিলের জন্য শহরের লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। তারা কোকিলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কোকিল ও কাকের চেহারার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও লোকজন কাকের নাম মুখে নেয় না। তাদের মুখে শুধু কোকিলের নাম-ডাক। এতে কাকেরা খুব অসম্মানবোধ করত। একদা তারা সিদ্ধান্ত নিল, তারা তাদের রাজার সঙ্গে দেখা করে তাদের অসম্মানবোধের বিষয়ে তুলে ধরবে এবং রাজার মাধ্যমে মানবসমাজের কাছে এর প্রতিকার দাবি করবে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক শহরের কাকগুলো এক দিন কাকরাজার সঙ্গে দেখা করল। কাকরাজার অনুমতি নিয়ে কাকগুলো তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরল। কাকের প্রতিনিধি কাকরাজাকে বলল, দেখুন রাজামশাই আমরা এই শহরের সবচেয়ে সম্মানীত প্রাণী। সমাজের লোকগুলো যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখে। ময়লা-আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ নির্গত হয়ে তা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পরিবেশের সৌন্দর্যহানি হয়। আমরা সুস্থ সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সর্বদা কাজ করে থাকি। আমরা মৃত প্রাণী ভক্ষণ করি। শহরের সৌন্দর্যবর্ধনে সর্বদা সচেষ্ট থাকি। এই সমাজে আমাদের অবদান অনিস্বীকার্য। আপনি আরো জানেন যে, আমরাই প্রথম মানবসমাজকে শিক্ষা দিয়েছি কীভাবে মৃতদেহ সৎকার করতে হয়। পৃথিবীর প্রথম মানব ছিলেন হজরত আদম (আ.)। তাঁর দুই ছেলের নাম ছিল হাবিল ও কাবিল। বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এতে কাবিল-হাবিলকে হত্যা করেছিল। তখন কাবিল ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল কী করবে এই ভেবে। ঠিক সেই সময় এক কাক অন্য একটি কাককে হত্যা করে মৃত কাকটিকে মাটিচাপা দিয়েছিল। কাবিল কাকের দেখাদেখি সেও অনুরূপভাবে তার ভাইকে মাটিচাপা দিয়েছিল। অথচ মানবসমাজে আজ আমাদের কোনো মূল্য নেই। তারা আমাদের কোনো সম্মান করে না। তারা শুধু কোকিলকে সম্মান করে। কোকিল খুব দুষ্টু প্রাণী। ওরা নিজেরা বাসা বানাতে পারে না। আমাদের বাসাতে ওরা ডিম পাড়ে। আর সেই ডিমে আমরা তা দিয়ে বাচ্চা ফোটাই। সেই বাচ্চা বড় করি। এরপরও আমাদের কোনো দাম নেই। মানবসমাজ বড় অকৃতজ্ঞ। আমরা আর এই শহরে থাকতে চাই না। এমন কোথাও চলে যেতে চাচ্ছি যেখানে মানুষের কোনো স্থান নেই। কাকের প্রতিনিধির সঙ্গে সুর মিলিয়ে অন্য কাকগুলো সমস্বরে একযোগে বলে উঠলÑ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা আর এই শহরে থাকতে চাই না। অন্য কোথাও চলে যাব।’

কাকরাজা সবার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল, তোমরা ঠিকই বলেছ। তোমাদের সঙ্গে একমত। আমাদের এই সমাজে আর বাস করা ঠিক হবে না। আমরা অন্য কোথাও চলে গেলে মানবসমাজ আমাদের প্রয়োজনীয়তা তখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করবে। ওদের একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত। তবে শ্রীখ- ত্যাগ করার আগে পাখির রাজাকে বিষয়টি অবহিত করা প্রয়োজন। দিনক্ষণ ঠিক করে কাকরাজা তার দলবল নিয়ে একদিন পাখির রাজা ঈগলের সঙ্গে দেখা করল। ঈগল মনোযোগ দিয়ে কাকরাজার কথা শুনল। তারপর সে বলল, তোমাদের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণ করার জন্য আমি একটা পরীক্ষা নিতে চাই। আগামীকাল তোমরা সবাই আমার দরবারে আসবে। আমি কোকিলদেরও আসতে বলব।

পরের দিন যথাসময়ে কাক ও কোকিল ঈগলের দরবারে হাজির হলো। ঈগল তাদের সবাইকে রাজকীয় খাবার খেতে দিল। খাবার খাওয়া শেষ হলে ঈগল কাকদের গান গাইতে বলল। কাকরা সবার সামনে তাদের গান পরিবেশন করল। এরপর ঈগল কোকিলদের গান করতে বলল। কোকিল মিষ্টি সুরে গান পরিবেশন করে সবাইকে মুগ্ধ করল। কাকরাও কোকিলের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তালি দিতে লাগল। এরপর ঈগল কোকিলদের বিদায় দিয়ে কাকদের নিয়ে বসল। ঈগল বলল, তোমরা হয়তো লক্ষ করেছÑ কোকিলরা কক্ষণও কোনো খাবার মাটিতে ফেলে খায় না। কোনো খাবার মাটিতে পড়ে গেলেও তুলে খায় না। ওরা গাছের ফলমূল খেতে পছন্দ করে। অথচ তোমরা খাবার মাটিতে না ফেলে খেতে পারো না। তোমাদের কর্কস স্বরের গান শুনলে সবাই বিরক্ত হয়। তোমরা মিষ্টি সুরে গান গাওয়ার চেষ্টা করো না। আর কোকিল মধুর সুরে গান করতে পারে। তাদের গান শুনে তোমরাও মুগ্ধ হয়ে তালি দিয়েছ। সত্যি বলতে কী কোকিলরা হলো বুদ্ধিমান। তারা মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা করে। ওরা অন্যদের দিয়ে কাজ করাতে সক্ষম। ওরা শিক্ষিত। আর তোমরা হলে মূর্খ, অশিক্ষিত। তোমরা খুব হিংসুক ও পরশ্রীকাতর। তোমরা কোনো জ্ঞানচর্চা করো না। তোমরা কখনো শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করো না। তোমরা হলে শ্রমিক শ্রেণি। তাই তোমাদের আজ এই পরিণতি। মূর্খের মতো দেশ ত্যাগ করা তোমাদের মোটেও ঠিক হবে না। তখন হয়তো দেখবে খাবারের অভাবে তোমাদের না খেয়ে মরতে হচ্ছে।

পাখির রাজা ঈগলের কথা শুনে কাকেরা তাদের ভুল বুঝতে পারল। তারা প্রতিজ্ঞা করল, আমরা আর কক্ষণও অন্যের ভালো দেখে হিংসা করব না। পরচর্চা করব না। আমরা এখন থেকে নিজেকে শিক্ষিত করার জন্য চেষ্টা করব। শ্রীখ- শহর ত্যাগ করা থেকে তারা বিরত থাকল। তারপর পাখির রাজা ঈগলের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে কাকগুলো আপন আপন ঠিকানায় ফিরে গেল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close