জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ অক্টোবর, ২০১৭

‘সন্দেহের’ বলি নিরপরাধ মানুষ

৮ বছরে গণপিটুনিতে নিহত ১০২৩

সিলেটের কিশোর রাজনকে ‘চোর সন্দেহে’ প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্মম নির্যাতনের সেই ভিডিওচিত্র ধারণ করে খোদ নির্যাতনকারীরাই! পরে সেটি আবার নিজের ফেসবুকে আপলোডও করে অভিযুক্তরা। লোমহর্ষক সেই নির্যাতনের ভিডিওচিত্র ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি এতটাই নির্মম আর পৈশাচিক ছিল যে, তা দেখে সিনেমার ভিলেনরাও আঁতকে ওঠেন। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্যাতনকারীদের মনে তার জন্য এতটুকুও মায়া হয়নি। তারা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, লাশও গুম করার চেষ্টা করেছিল। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত এ ঘটনায় দেশে-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও রাজন হত্যার ক্ষত এখনো দগদগে। কারোর মন থেকেই তা মুছে যায়নি। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের গৌরীপুরে মধ্যযুগীয় কায়দায় খুঁটির সঙ্গে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাগর মিয়া (১৮) নামে এক কিশোরকে। হত্যাকান্ডের সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। রাজনের মতো হাত-পা ভেঙে এবং শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ থেঁতলে তাকেও হত্যা করা হয়। তাহলে এই ভয়াবহতার শেষ কোথায়?

শুধু রাজন কিংবা সাগর নয়, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিনই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মানুষজনকে। চোর, ডাকাত, পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরা পড়লে গণপিটুনি দেওয়াটা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে পিটুনিতে যখন এসব কিশোরকে মারা হচ্ছিল, তখন আশপাশে দাঁড়িয়ে তা ‘উপভোগ’ করেছে উৎসুক জনতা। তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ। এই কিশোরদের বাঁচার আকুতি যেন কানে পৌঁছায়নি ‘মজা দেখা’ উৎসুক জনতার।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার কাছে ‘সন্দেহের পিটুনি’তে নিহতের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত আট বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১০২৩ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১২৭ জন। ২০১০ সালে প্রাণ হারিয়েছে ১৭৪ জন। ২০১১ সালে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। ২০১২ সালে ১৩২ জন। ২০১৩ সালে ১২৫ জন। ২০১৪ সালে ১১৬ জন। ২০১৫ সালে ১৩৫ জন। ২০১৬ সালে ৫৩ জন। আর চলতি বছর অর্ধশতাধিক মানুষ গণটিুনিতে নিহত হয়েছে। সর্বশেষ গত তিন সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। পূর্বশত্রুতার জেরে চোর কিংবা ছিনতাইকারী অপবাদ দিয়ে সাধারণ মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটছে। আইনের শাসনের অভাব এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মানুষের আস্থাহীনতায় এসব গণপিটুনিতে হত্যাকান্ডের ঘটনা থামছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতি আস্থাহীনতার অভাবে গণপিটুনির মতো ভয়াবহ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। অপরাধ করেও ঘুষ আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ায় গণপিটুনির মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা বাড়ছে। দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলে তা খুন হিসেবে গণ্য হবে। যার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার হয়নি। গণপিটুনির ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি করে পুলিশের বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকে মনে করে গণপিটুনির আইনি বৈধতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। তবে এসব ঘটনার যথাযথ তদন্ত হয় না। অপরাধীরা গণপিটুনিতে নিহত হলে স্বজনদের বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বিনা অপরাধে হত্যার অভিযোগ উঠলে বিচার পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। অপবাদ সহ্য করে বিচারের আশা ছাড়তে হচ্ছে স্বজনদের।

মানবাধিকার কর্মী ও আসকের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হারানোর কারণে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় গণপিটুনির শিকার হয়ে নির্দোষ মানুষও নিহত হচ্ছে। পূর্বশত্রুতার জেরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপরাধী সাজিয়ে পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। গণপিটুনির ঘটনায় থানায় মামলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচার হয় না। এসব ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেফতার না করে মামলায় অজ্ঞাত অসংখ্য আসামি করে বাণিজ্য করা হয়।

এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, একজন খারাপ লোককেও গণপিটুনি দিয়ে মারা যাবে না। এটা অসাংবিধানিক। কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে গণপিটুনিতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। এসব ঘটনার তদন্ত হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা গণপিটুনিতে নিহত হওয়ায় মামলায় সাক্ষী পাওয়া যায় না। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটে চুরির অভিযোগ তুলে ১৩ বছরের শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার পর সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যম সোচ্চার হয়। হত্যাকারীদেরই এক সহযোগী নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিলে সারাদেশে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ। সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর এ মামলার রায়ে চারজনকে ফাঁসির আদেশ দেন। এই ঘটনার পর ২০১৬ সালে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা কমে ৫৩ জন হয়। তবে ২০১৭ সালে আবার গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণপিটুনিতে হত্যা বন্ধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গণমাধ্যম ও জনগণকে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।

এদিকে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে গণপিটুনির শিকার হয়েছে শিশুসহ ২০ জন। এর মধ্যে সাতজন মারা গেছে। ৯ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গরুচোর সন্দেহে চারজন এবং এর ছয় দিন আগে কক্সবাজারের চকরিয়ায় ডাকাত সন্দেহে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর ওয়ারীতে গণপিটুনিতে নাদিম (৩০) নামে এক যুবক মারা গেছে ছিনতাইকারী অভিযোগে। সর্বশেষ ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার চর শ্রীরামপুর গ্রামে চুরির অভিযোগে কিশোর সাগর মিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ১ মার্চ বনশ্রীর ই-ব্লকে সাইকেল চুরির অভিযোগে মানিক নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ২ জুন মোহাম্মদপুরের চান মিয়া হাউজিং এলাকায় শামীম নামে আরেক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে জনতা। গত ১৮ জুলাই খুলনার খালিশপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে শাহজালাল নামে এক যুবককে পেটানো হয়। পরে পুলিশ চোখ উপড়ানো অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। পুলিশ হেফাজতে থাকার সময় তার চোখ উপড়ে ফেলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে তার বাবা জাকির হোসেন বলেছেন, পেশায় সবজি ব্যবসায়ী শাহজালাল ছিনতাইয়ে জড়িত নয়। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়নের আটগড়ি এলাকায় পুলিশের একটি দলকে চোর সন্দেহে পিটুনি দেয় গ্রামবাসী। পুলিশের এএসআই সোহেল রানা গুরুতর আহত হন। এর আগে গত বছরের আগস্টে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আসামি ধরতে গিয়ে গণপিটুনিতে এক পুলিশ কনস্টেবলের মৃত্যু হয়। ছয় বছর আগে ২০১১ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের আমিনবাজার এলাকার বরদেশী গ্রামে শবেবরাতের রাতে ঘুরে বেড়ানো ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহের বশে পিটিয়ে গ্রামবাসীর হত্যার ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল।

সন্দেহের বশে গনপিটুনিতে নিহতদের ব্যাপারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের নিঃসন্দেহ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সন্দেহের বশে গণপিটুনিতে করুণ মৃত্যু হয়। জনরোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশ তৎপর হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশেরই জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

গণপিটুনি ব্যাধির এই ভয়াবহ বর্বরতার বিষয়ে সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, শিশু-কিশোরদের হত্যার নৃশংস ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত নয়। বরং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে সেই ছবি প্রকাশ করা উচিত। এতে করে অন্য যারা এ ধরনের নির্যাতন করে, তাদের মনে ভয় ঢুকবে, নিজেদের ভুল তারা শুধরে নেবে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, সাগর ও রাজনদের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য সুশাসনের অভাবই দায়ী। আসামিদের বিচারের আওতায় আনতে না পারায় তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থের জোরে অপরাধ করেও রেহাই পাচ্ছে। সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist