হাসান শান্তনু

  ২১ আগস্ট, ২০১৭

শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা

শুধু ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলাই নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২১ বার হামলা হয়েছে। কখনো নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায়, আবার কখনো তার গাড়ির বহরে। বর্তমান বিশ্বের কোনো দেশের রাষ্ট্রনায়ককে এত বার হত্যা চেষ্টার নজির নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকার কারণে বোন শেখ রেহানাসহ বেঁচে গেলেও দেশে ফেরার পর থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফেরার পর থেকেই তার ওপর একের পর এক হামলা হয়েছে।

প্রতিবার তিনি বেঁচে গেলেও জীবন দিতে হয়েছে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে। এর মধ্যে ১৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে কেবল দুটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে গতকাল রোববার।

সব ঘটনায় মামলাও হয়নি। এমনকি হামলার পর উল্টো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার নজিরও আছে। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গতকাল ১০ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন ও তিনজনের ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদ-ের আদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২।

রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করেন, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যাকে বারবার হত্যার চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করে আসছে অপশক্তি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি, পঁচাত্তরের ঘাতক ও দেশি-বিদেশি মৌলবাদী গোষ্ঠী তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন চায়। পরাজিত শক্তি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে মুছে দিতে চায়।

অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসীন হয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন, যাতে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাকেই বারবার হত্যার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকেই বারবার হামলা হয়।’ তিনি বলেন, ‘তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে পদানত করা ও শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে না পারলে এ ধারাকে পদানত করা সম্ভব নয়। সবাইকে তারা কিনতে পারছে বা পারবে হয়তো, কিন্তু শেখ হাসিনাকে নয়, এ জন্যই তাকে হত্যা করতে হবে। শেখ হাসিনা ফিনিক্সের মতো। ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পরও আবার স্বমূর্তিতে জেগে উঠেছেন।’

জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা এখনো সক্রিয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি শরিফুল হক ডালিম ও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ১৬ জন ও কর্মরত সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করেন। যা উইকিলিকসের সৌদি আরবের এক গোপন বার্তায় প্রকাশ পায়। হংকংয়ে বসবাসরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ইসরাক আহমেদ এ পরিকল্পনায় অর্থায়ন করেন বলে গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াল গ্রেনেড হামলার মূল টার্গেট ছিলেন। সেদিন ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও তার কান ও চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো কান ও চোখের পীড়া থেকে পুরোপুরি মুক্ত হননি শেখ হাসিনা। তিনি প্রথম হামলার শিকার হন ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, চট্টগ্রামে। লালদীঘি ময়দানের আটদলীয় জোটের মিছিলে তাকে হত্যায় পুলিশ ও বিডিআর গুলি বর্ষণ করে। এতে সাতজন নিহত ও গুরুতর আহত হন ৫৪ জন। ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি বর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা চালায়।

১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় ফিরে গ্রিনরোডের কাছে ধানমন্ডি স্কুলে উপনির্বাচনের ভোট দেওয়ার পর গ্রিনরোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান। গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির কর্মীরা গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে তাকে বহনকারী রেল গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর শেখ রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দানরত অবস্থায় শেখ হাসিনার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়।

১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে ২০ জন আহত হন। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্র-কন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেইল করে ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে ও হ্যালিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল। ঘটনাস্থলের কাছে শেখ লুৎফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠের এক সভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য রাখার কথা ছিল। ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জঙ্গিরা সেখানে বোমা পুঁতে রাখে, যা গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে।

২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেট গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেদিন রাত ৮টার দিকে জনসভাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলে দুজনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। ২০০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায়। ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তার গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপি। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সেনাবাহিনী সমর্থিত এক/এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাকে গ্রেফতার করেছিল। তাকে রাখা হয়েছিল জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাবজেলে। সে সময় শেখ হাসিনার খাবারে ক্রমাগত পয়জন দিয়ে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। ২০০৯ সালের ২৭ জুন রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, ‘কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নারী কারারক্ষীদের কাছ থেকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টার বিষয়টি তিনি অবগত হন। বিষয়টি শেখ হাসিনাকে জানান। এরপর শেখ হাসিনা কারাগারে চিড়া, মুড়ি ও কলা খেয়ে থাকতেন। ১১ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি প্যারোলে মুক্তি পান।’

২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চুক্তি করে। এর জন্য আগাম পেমেন্টও দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার লক্ষ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা পরে ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গি শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার। ২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময়ে কারওয়ানবাজারে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জেএমবি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist